পশ্চিমা দেশেগুলোতে দ্বীন প্রচার - একটি পর্যালোচনা | Western Dawah

 পশ্চিমা দায়ী সংকট:

১) মুসলিমদের জন্য কুফুরের পরিবেশে বসবাস করাটাই বিপদজনক। এটা তাদের ঈমানের জন্য হুমকির কারণ। মুসলিমদের জন্য কাফিরদের ভূমিতে স্থায়ী বসবাসের অপারগতা, প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবতার প্রশ্নে পরে আসছি। আমাদেরকে প্রথমে বুঝতে হবে এর বৈধতার প্রশ্নে ইসলাম কেন এতো কঠোর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, " মুশরিকদের মধ্যে বসবাসরত প্রত্যেক মুসলিম থেকে আমি মুক্ত।" ঠিক একই মর্মের আরো কয়েকটি রেওয়ায়েত পাওয়া যায়। 

মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, নিশ্চয় যারা নিজেদের প্রতি যুলুমকারী, ফেরেশতারা তাদের জান কবজ করার সময় বলে, 'তোমরা কী অবস্থায় ছিলে'? তারা বলে, 'আমরা যমিনে দুর্বল ছিলাম'। ফেরেশতারা বলে, 'আল্লাহর যমিন কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিজরত করতে'? সুতরাং ওরাই তারা যাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম। আর তা কতই না মন্দ প্রত্যাবর্তনস্থল।(সূরা নিসা-৯৭)

এতো কঠোরতার কারণ এটাই যে, এই বসবাসের ফলে একজন মুমিনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ঈমান হুমকির মুখে থাকে। এমনকি ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় সে ইসলাম বিরোধী পরিকল্পনার অংশ হয়ে যাওয়ার আশংকায় থাকে। ইসলামের প্রতি তার কমিটমেন্ট নষ্ট হতে থাকে। শাইখ আব্দুল্লাহ আজ্জাম রহিমাহুল্লাহ তার পুরো তাফসীরে তাওবা জুরে স্থায়ীভাবে ইউরোপে বসবাসের ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন ঘটনা, পরিচিত-অপরিচিত নানা মানুষের অবস্থা তুলে ধরে তিনি দেখানোর চেষ্টা করেছেন, কীভাবে তারা আল্লাহর শরীয়ত থেকে দূরে সড়ে আসতে থাকে। 

শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ ইবনে উসাইমিন রহিমাহুল্লাহ বলেন, "কাফির দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করা একজন মুসলিমের দ্বীনি দায়িত্ব, নৈতিকতা, আচরণ ও আদবের জন্য মারাত্মক হুমকি বহন করে। আমরা অনেকেই দেখেছি, যারা এসব দেশে সেটেল হয়েছে তারা গোমরাহ হয়েছে এবং পরিবর্তিত হয়ে ফিরে এসেছে। তারা ফাসিক-ফাজির হয়ে ফিরে এসেছে। অনেকে মুরতাদ হয়ে গেছে এবং নিজের দ্বীনসহ সব ধর্মে অবিশ্বাসী হয়ে ফিরেছে। তারা দ্বীনকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে এবং দ্বীন ও এর অনুসারীদের; অতীত ও বর্তমান নিয়ে বিদ্রূপ করে। আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। কীভাবে একজন মুসলিম কাফিরদের ভূখণ্ডে জীবন কাটানোর ব্যাপারে পরিতৃপ্ত হতে পারে, যেখানে প্রকাশ্যে কুফুরের আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয় এবং আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আইন ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে শাসন করা হয়? নিজ চোখে এসব দেখার পর, নিজ কানে এসব শোনার পর একসময় অন্তর এগুলোর অনুমোদন দিতে থাকে...।" (মাজমুঊ ফাতাওয়াশ শাইখ ইবনে উসাইমিন, ফতোয়া নং ৩৮৮)

বিশেষ প্রয়োজনে সাময়িক সময়ের জন্য সেখানে অবস্থান ভিন্ন কথা। সেক্ষেত্রেও অনেক সতর্কতা জরুরি। তবে অধিকাংশ মুসলিমই সেখানে সেটেল হোন পার্থিব সুখ ও উন্নতির জন্য। দ্বীনের প্রতি তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ থাকে না।অথচ ইমামরা এই ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোরতা দেখিয়েছেন। কারণ মানুষ অবশ্যই তার পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়। পারিপার্শ্বিক এই প্রভাব থেকে মুমিন দ্বীনের ব্যাপারে সংবেদনশীলতা হারাতে থাকে। দীর্ঘ সময় একটা বিষয় দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে দ্বীনের ব্যাপারে গায়রাত ফওত হয়ে যায়। পাশ্চাত্য পরিবেশের সাথে ইসলামের নির্দেশগুলোর বিরোধ দেখে তার মাঝে হীনমন্যতা কাজ করে। আর তখনই তার ভিতরে উক্ত পরিবেশ বিরোধী ইসলামের প্রতিটি বিধান নিয়ে সংশয় কাজ করতে থাকে। এই সংশয়ে কেউ কেউ সরাসরি মুরতাদ হয়ে যায়। আর কেউ কেউ নানাভাবে কম্প্রোমাইজ ও কাটছাঁটের আশ্রয় নেয়। পরিস্থিতির শিকার এমন বিকৃতিকে ইজতিহাদ, ফিকহুল হাল ইত্যাদি দ্বীনি টার্ম দিয়ে গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করা হয়। এটাই বাস্তবতা। সত্য গ্রহণের মানসিকতা নিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আপনি এই ফলাফলের সাথে অবশ্যই একমত হবেন। এজন্য প্রথমত আমাদেরকে কাফেরদের ভূমিতে বসবাসের বিষয়টিকেই ইসলামী শরীয়ার আলোকে বিবেচনায় নিতে হবে।

এখানে একটা প্রশ্ন আসতে পারে, বর্তমান মুসলিম দেশগুলোর অবস্থাও তো এক। একথা সত্য, মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামী শরীয়াহ প্রতিষ্ঠিত নেই। তবুও এই ভূখণ্ডগুলোর সামাজিক বাস্তবতায় পশ্চিমের সাথে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। এটা আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। হ্যাঁ এটা অনস্বীকার্য যে, মুসলিম দেশগুলোও দিন দিন সেদিকে এগোচ্ছে এবং এটা খুব দ্রুতই। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এখনো উক্ত প্রশ্ন কার্যকর হওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

২) মহান আল্লাহ তা'য়ালা সকল মানুষের অন্তর্যামী। কাফেরদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে তিনিই সর্বাধিক অবগত। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, "আর ইয়াহুদি ও নাসারারা কখনোই তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবে না যতক্ষণ না তুমি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ করো।" (সূরা বাকারা-১২০)

একই মর্মের বেশ কয়েকটি আয়াত রয়েছে পবিত্র কুরআনে। যদি এটাই কাফেরফের মনস্তত্ত্ব হয়, তাহলে বুঝতে হবে কাফেররা পরিপূর্ণভাবে আপনার দ্বীন পালন করতে দিবে না। তাদের মিল্লাতের কিছু বিষয়কে মেনে নিতেই হবে। তবেই তারা আপনার প্রতি আশ্বস্ত হবে। সাথে তাদের মিল্লাতের সাথে যেকোন প্রকার সংঘর্ষিক এক্টিভিটি তারা আপনার থেকে সহ্য করবে না। 

বর্তমান বাস্তবতায় বুঝতে হলে সেকুলারিজম ও লিবারেলিজমের উদাহরণ খুবই সুস্পষ্ট। এগুলো কুফফারদের দ্বীন। কাফেরদের রাষ্ট্রে এগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে হয়ত আপনি টিকে থাকতে পারবেন না। আপনি যদি বিশুদ্ধভাবে ইসলাম পালন করতে চান, এগুলোর সাথে কোন না কোনভাবে সংঘর্ষ বাঁধবেই। 

এই বাস্তবতাকে আমরা মেনে নিলাম। সাথে সাথে ইসলামী শরীয়ার আলোকে বিবেচনার পর ধরে নিলাম, পাশ্চাত্য দেশে আপনার বসবাস একটা অপারগতা কিংবা প্রয়োজনীয়তা। (যদিও অধিকাংশের ক্ষেত্রেই বাস্তবতা ভিন্ন) এখন একদিকে আপনাকে সেখানে অবস্থান করতে হচ্ছে, অন্যদিকে কাফেররা আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না যদি না আপনি তাদের মিল্লাতকে মেনে নিন। তাদের পক্ষ থেকে সত্যিকার অর্থেই আপনার হত্যা কিংবা অঙ্গহানি হওয়ার আশংকাও আছে। এই পরিস্থিতিতে আপনার করণীয় কী? 

এই পরিস্থিতিতে আপনি হয়ত তুকিয়া অবলম্বন করতে পারেন। তুকিয়া হল মৌখিক আপোষ কিংবা তোষামোদ। কিন্তু আন্তরিকভাবে কখনোই আপোষ করা বিষয়গুলোকে সমর্থন করা যাবে না। তখন সেটা আর তুকিয়া থাকবে না। আবার যেকোন ক্ষেত্রেই তুকিয়া অবলম্বন করা যাবে না। নিশ্চিতভাবে তুকিয়া গ্রহণ না করার কারণে আপনার হত্যা ও অঙ্গহানির আশংকা থাকতে হবে। 

এখানে আরেকটা বিষয় ক্লিয়ার হওয়া দরকার। তুকিয়ার ব্যাপারটা পরিপূর্ণভাবে একজন নাগরিকের সাথে প্রাসঙ্গিক। কেউ যদি নিজেকে একজন দায়ী হিসেবে দাবী করে, তার জন্য বৈধ নয় তুকিয়ার আশ্রয় নিয়ে মানুষের কাছে ইসলামকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা। কারণ দায়ীর দায়িত্ব হল, ইসলামকে সঠিকভাবে কোন প্রকার বিকৃতি ছাড়া হীনমন্যতায় না ভুগে আপোষহীনভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরা। 

আল্লাহর ইচ্ছায় যারা মানার তারা মেনে নিবে আর যারা প্রত্যাখ্যান করার করবে। দায়ীর দায়িত্ব নয় মানুষকে আশ্বস্ত করার জন্য বিকৃতভাবে আপোষের সাথে দ্বীনকে উপস্থাপন করা। (আলহামদুলিল্লাহ কাফেরদের রাষ্ট্রে থেকেও কিছু দায়ী আপোষহীনভাবে দ্বীনকে প্রচার করে যাচ্ছেন) যদি কোন দায়ী সামগ্রিকভাবে আপোষহীনতা ধরে না রাখতে পারেন, তার জন্য উচিৎ হল অন্ততপক্ষে সেসব বিষয়ে নিশ্চুপ থাকা যেখানে সে আসলেই অক্ষম। 

তথাপি আমরা মেনে নিলাম কোন দায়ীর উপর বিভিন্ন মহল থেকে চাপ ও এজেন্ডা থাকে ইসলামের সেসব বিষয়ে আপোষপূর্ণ কথাবার্তা বলার, যেগুলো পাশ্চাত্য লিবারেলিজমের সাথে সাংঘর্ষিক। এটাকে উক্ত দায়ীর জন্য তুকিয়া হিসেবেই ধরে নিলাম। 

কিন্তু আমাদেরকে বুঝতে হবে, তুকিয়া বাহ্যিক বিষয়। বিশ্বাসের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই এবং তুকিয়া দাওয়াতের বিষয়বস্তুও নয়। সহজ বাংলায় বললে, এটা কাফেরদের সাথে প্রতারণা। এমন দ্বীমুখীতা অনেক সময় কফেরদের দেশে বৈধ হয়। এটাকে নিফাকের মত শর'য়ী অভিধেয় দেয়া যায় না। ( যেমনটা কিছু বিভ্রান্ত মুসলিম চিন্তক দাবি করে)

পাশ্চাত্যে বসে আপনি পর্দার ব্যাপারে আপোষের কথা বলছেন, ফ্রি মিক্সিং নিয়ে ছাড়ের সবক দিচ্ছেন, LGBT অধিকার মেনে নিচ্ছেন, মোট কথা পাশ্চাত্য পরিবেশের সাথে সাংঘর্ষিক এমন সব ইসলামী বিধানের ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ করছেন। মুসলমানদের প্রতি সুধারণাবশত আমরা মেনে নিচ্ছি এগুলো তুকিয়ার অংশ। 

কিন্তু যেই বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল, ইলমীভাবে উক্ত বিষয়গুলোতে অবশ্যই আপনাকে ইসলামের ট্রাডিশনাল অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। একাডেমিকভাবে কোন প্রকার আপোষ ছাড়াই আপনাকে  ইসলামের এসব সুস্পষ্ট বিধানে বিশ্বাস রাখতে হবে। মোটকথা ঈমান ও ইলমের জায়গায় আপনাকে সৎ থাকতে হবে। এটা না হলে আপনি তুকিয়ার সীমালঙ্ঘন করে ফেললেন। যেটা অনেক সময় রিদ্দাও হতে পারে। আল্লাহর পানাহ!

আগেই বলেছি যে, তুকিয়া দাওয়ার বিষয় না। এটা মুসলিমদের আইডোলজিও না। একজন পাশ্চাত্য দায়ীর এমন বিকৃতিকে আপনি দাওয়াত হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন না। ইসলাম এর বৈধতা দেয়নি আপনাকে। এসব বিষয়ে অবশ্যই আপনাকে এড়িয়ে চলতে হবে পাশ্চিমা দায়ীকে। 

কারণ তিনি তুকিয়ার অবস্থানে আছেন। তিনি নিজেকে এমন অবস্থানে আবিষ্কার করতে পারছেন না, যেখান থেকে ইসলামকে আপোষহীনভাবে তুলে ধরতে পারেন। বড় পরিতাপের বিষয় হল, পশ্চিমা দায়ীদের বিভ্রান্তি কথা বললে কিছু ভাই ঠিকই নসীহত করেন যে, তারা চাপে থাকে, পশ্চিমা সমাজের সাথে সাংঘর্ষিক কোন কথা তারা বলতে পারেন না। 

কিন্তু সেসব ভাই এই বাস্তবতার সবক দেয়ার পাশাপাশি এর ফলাফলকে মেনে নিতে চান না। তারা ঠিকই আপোষ নীতিকে আইডোলজি হিসেবে গ্রহণ করছে, ইলমীভাবে মেনে নিচ্ছে। আবার সাধারণ মুসলিমদেরকে তুকিয়ার স্বার্থে গ্রহণ করা মত-অবস্থানের দাওয়াতও দিচ্ছে। অথচ উক্ত বাস্তবতার ফলাফল এটাই যে, তাদের থেকে আপোষহীন ভাবে ইসলামের সঠিক বিধানটা আসবে না। 

ফলে আমাদের জন্য জরুরী হল, পশ্চিমে অবস্থান করা এসব স্কলার, দাঈ বা প্রতিষ্ঠান থেকে ইলম নেয়া ও তাদের মত-অবস্থানের অনুসরণ করা সতর্কতার সাথে এড়িয়ে চলা।

Read Also :

Getting Info...

Post a Comment

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.