মুকাল্লিদের অভিযোগ ও তার জবাবঃ
মুকাল্লিদের অভিযোগ :
তারাবীহ শব্দটাই প্রমাণ করে এটি ২০ রাকাআত। কেননা, লফজ তারাবীহ (تراويح) হলো তারবিহাতুন (ترويحة) এর বহুবচন (جمع)। তারবিহাতুন অর্থ হলো বিশ্রাম নেয়া। তারাবীহ’র নামাযে যেহেতু চার রাকাআত পর পর বিশ্রাম নেয়া হয়, সেজন্য এই নামাযের নাম তারাবীহ রাখা হয়েছে।
আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী কোনকিছু কমপক্ষে ৩ (তিন) সংখ্যক না হলে সেক্ষেত্রে বহুবচন (جمع) ব্যবহৃত হয় না। কাজেই ৮ রাকাআত কখনো তারাবীহ হতে পারে না। কেননা, এখানে তারবিহাহ তথা বিশ্রামের সংখ্যা হয় বড়জোর দুইটা। আর দুই তারবীহাহ কোনভাবেই তারাবীহ হতে পারে না। এই নামায ৮ রাকাআত হলে ব্যাকরণ অনুযায়ী সেটাকে তারবিহাতানে (ترويحتان) বলতে হবে। শরীয়তে যার অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই।
লা-মাযহাবীরা নাহু-সরফ (আরবী ব্যাকরণ) বুঝেনা বলেই ৮ রাকাআতকে তারাবীহ বলা আরম্ভ করে দিয়েছে।
আমাদের জবাব :
প্রথমতঃ আরবীতে সর্বনিম্ন কত সংখ্যকের জন্য বহুবচন ব্যবহৃত হতে পারে এ নিয়ে বিদ্বানগণের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। মুলত এটি একটি অমিমাংসিত ইখতিলাফ, যা সাহাবাদের যুগ থেকে চলে আসছে। যেমন ইমাম ইবনে হাযম (রহ.) স্বীয় ‘আল আহকাম ফী উসূলিল কুরআন’ (১/১৯৬ পৃষ্ঠা) গ্রন্থে উল্লেখ করেন-
اختلف العلماء في أقل الجمع: هل هو اثنان أو ثلاثة؟ …فنقول مذهب عمر وزيد بن ثابت ومالك وداود والقاضي أبي بكر والأستاذ أبي إسحاق وجماعة من أصحاب الشافعي رضي الله عنه كالغزالي وغيره أنه اثنان
ومذهب ابن عباس والشافعي وأبي حنيفة ومشايخ المعتزلة وجماعة من أصحاب الشافعي أنه ثلاثة…
احتج الأولون بحجج من جهة الكتاب والسنة
“(আরবীতে) বহুবচনের জন্য সর্বনিম্ন সংখ্যা কত এ নিয়ে বিদ্বানগণের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। অর্থাৎ সেই সংখ্যা কি দুই নাকি তিন?...
ইবনে হাযম (রহ.) বলেন- ওমর (রা.), যায়েদ বিন ছাবিত (রা.), ইমাম মালেক (রহ.), দাউদ যাহেরী (রহ.), কাযী আবু বকর (রহ.), আবু ইসহাকের উস্তাদ ও শাফেয়ীদের একটি দল যেমন ইমাম গাযালী (রহ.) ও অন্যান্যদের অভিমত হলো সেই সংখ্যা ‘দুই’।
পক্ষান্তরে ইবনে আব্বাস (রা.), ইমাম শাফেয়ী (রহ.), ইমাম আবু হানিফা (রহ.), মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের আলেমগণ ও শাফেয়ীদের একটি দলের অভিমত হলো সেই সংখ্যা ‘তিন’।…
প্রথমোক্ত অভিমত যারা দিয়েছেন, উনারা কুরআন ও সুন্নাহ’র আলোকে এটি গ্রহণ করেছেন।”
তবে ইমাম বদরুদ্দীন আল যারকাশী (রহ.) স্বীয় ‘আল বাহরুল মুহীত’ (১/৩৯৬ পৃষ্ঠা) গ্রন্থে একদলের অভিমত উল্লেখ করে দারুন বলেছেন।–
أقل الجمع اثنان لأن قال الشيء إما واحد وإما كثير لا غير فجعل الاثنين في حد الكثرة
“বহুবচনের সর্বনিম্ন সংখ্যা হলো দুই। কেননা, কোন বস্তু সম্পর্কে বলা হয় এখানে হয়ত একটি নতোবা বেশি। এ ছাড়া কিছু নয়। এভাবে দুইকে বেশির মধ্যে গণ্য করা হয়েছে।”
দ্বিতীয়তঃ তারাবীহ শব্দ দ্বারা তারাবীহ’র নামায ২০ রাকাআতই এ কথাও প্রমাণ করে না। কেননা, আরবীতে বহুবচন শুধুমাত্র ২০ এর জন্য খাস তারাই বলতে পারে যারা আরবীর ‘আ’ও শেখেনি। আরবী ব্যাকরণের সাধারণ নিয়ম হলো, বহুবচন (جمع) দুই বা তিন থেকে আরম্ভ করে উপরে যে কোন সংখ্যার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। এই হিসেবে যদি ৩(তিন) থেকে ধরি, তাহলে তারাবীহ ১২ রাকাআতও হতে পারে, ৩৬ রাকাআতও হতে পারে, আবার ৪০ রাকাআতও হতে পারে। অনেকেই ৩৬ রাকাআত, ৪০ রাকাআত ইত্যাদি পড়েছেন। কাজেই নির্দিষ্ট করে ২০ রাকাআত বলা ব্যাকরণ পরিপন্থী।
তৃতীয়তঃ তারাবীহ শব্দটা না আছে কুরআনে, আর না আছে কোন প্রমাণিত হাদীসে। এটি মুহাদ্দিছগণের সৃষ্ট পরিভাষা। যা পরবর্তীতে সৃষ্টি হয়েছে। তাই ইসলাম পূর্ণ হওয়ার পরে সৃষ্টি হওয়া কোন পরিভাষা দ্বারা ইসলামের পূর্ববর্তী সাব্যস্ত কোন হুকুম বাতিল হতে পারে না। যদি মেনেও নিই যে এই পরিভাষার সাথে রাকাআত সংখ্যা ৮ হওয়া যৌক্তিক নয়, তবুও ৮ রাকাআত বাতিল হবে না, পরে সৃষ্টি হওয়া পরিভাষাটাই বাতিল হবে। কেননা, এই পরিভাষা পরে সৃষ্টি হয়েছে এবং ৮(আট) রাকাআতের পক্ষে দলিল রয়েছে।
আবারো প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে কি মুহাদ্দিছগণ গলদ কাজ করেছেন? উনারা কি আরবী কম জানতেন? নাহ, উনারা সঠিক কাজই করেছেন এবং আরবীও উনাদের চাইতে ভাল আমরা কেউই জানি না।
মুলত বহুবচনের জন্য কমপক্ষে ৩(তিন) সংখ্যক হওয়া এটা হচ্ছে ব্যাকরণের প্রসিদ্ধ নিয়ম। তবে কখনো কখনো ২(দুই) সংখ্যকের ক্ষেত্রেও বহুবচন ব্যবহৃত হওয়া ব্যাকরণ সিদ্ধ ব্যাপার। যার উদাহরণ আমরা কুরআন হাদীস থেকেই পেশ করবো ইনশাআল্লাহ। আশা করি তখন আর কোন আপত্তি অবশিষ্ট থাকবে না। কেননা, ভুল ব্যাকরণে থাকতে পারে কিন্তু কুরআন হাদীসে তা অসম্ভব। আর এ কথা তো সর্বজন স্বীকৃত যে কুরআন হাদীস কোন ব্যাকরণিক নীতির আদলে চলে না, বরং ব্যাকরণই উল্টো কুরআন হাদীসের নীতির মুহতায।
প্রথমে আকলী দলিলঃ
আমরা সকলেই অবগত আছি যে, ওয়াক্তিয়া নামায জামাআত সহকারে পড়া ওয়াজীব যদি কোন ওযর না থাকে। মাত্র দুইজন লোকও যদি হয় তাহলেও জামাআত করে ফরয সালাত আদায় করতে হবে (বুখারী হা/৬২৭ মা.শা.)। এছাড়াও ইমাম বুখারী (রহ.) বাব রচনা করেছেন باب اثنان فما فوقهما جماعة “অধ্যায়- দু’জন বা ততোধিক ব্যক্তি হলেই জামাআত”।
এই পরিস্থিতিতে মাত্র দুইজন লোক হওয়ার কারণে কেউ এ কথা বলতে পারবে না যে ওটা জামাআত হয়নি, জামাআত হওয়ার জন্য কমপক্ষে তিনজন ব্যক্তি হওয়া জরুরী। সুতরাং বুঝা গেল ২(দুই) এর ক্ষেত্রেও বহুবচন (جمع) ব্যবহৃত হয়।
কুরআন থেকে প্রমাণঃ
(১) إن تتوبا إلى الله فقد صغت قلوبكما
“(ওহে নবীর স্ত্রীদ্বয়) যদি তোমরা উভয়ে আল্লাহ্র দিকে ফেরো, কেননা তোমাদের হৃদয় ইতিপূর্বেই ঝোঁকে গেছে।” (তাহরীম/৪)
এই আয়াতে মহান আল্লাহ মাত্র দুইজনের ক্ষেত্রে বহুবচন ‘কুলুব’(قلوب) ব্যবহার করেছেন, যার একবচন হলো ‘ক্বলবুন’ (قلب)। ব্যাকরণের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী এটা ‘কলবানি’ (قلبان) হবার কথা ছিল।
(২) وإن طائفتان من المؤمنين اقتتلوا
“আর যদি মুমিনদের দুটি দল লড়াই করে...” (হুজুরাত/৯)
এই আয়াতেও দুটি দলের জন্য বহুবচন ‘ইকতাতালু’ (اقتتلوا) ব্যবহৃত হয়েছে। যা ‘ইকতাতালা’ (اقتتلا) হবার কথা ছিল।
(৩) هذان خصمان اختصموا
“এরা হচ্ছে দুই প্রতিপক্ষ যারা বিতর্ক করে...” (হাজ্জ/১৯)
এখানেও দুই দলের ক্ষেত্রে বহুবচন ‘ইখতাছামু’ (اختصموا) ব্যবহৃত হয়েছে, যা হবার কথা ছিল (اختصما)।
(৪) قال كلا فاذهبا بآياتنا إنا معكم مستمعون
“তিনি বললেন- কখনো না! অতএব তোমরা দুজনেই আমার নিদর্শন সমূহ নিয়ে যাও, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সঙ্গে রয়েছি শুনতে থাকা অবস্থায়।” (শুআরা/১৫)
এই আয়াতে দুইজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বহুবচন ‘কুম’ (كم) ব্যবহৃত হয়েছে। অথচ হবার কথা ছিল ‘কুমা’ (كما)।
(৫) عسى الله أن يأتيني بهم جميعاً
“হতে পারে আল্লাহ্ ওদের সবাইকে আমার কাছে এনে দেবেন।” (ইউসূফ/৮৩)
এখানেও বহুবচন ব্যবহৃত হয়েছে ইউসূফ (আ.) এবং তাঁর ভাই এই দু’জনের জন্য।
(৬)وداوود وسليمان إذ يحكمان في الحرث إذ نفشت فيه غنم القوم وكنا لحكمهم شاهدين
“আর দাউদ এবং সুলাইমানের ক্ষেত্রে, স্মরণ করো, তাঁরা হুকুম দিয়েছিলেন এক শস্যক্ষেত্র সম্পর্কে যাতে লোকদের ভেড়া ঢুকে পড়েছিল রাতের বেলা, আর আমরা তাঁদের হুকুমের সাক্ষী ছিলাম।” (আম্বিয়া/৭৮)
এখানেও দাউদ (আ.) ও সুলাইমান (আ.) এই দুইজনের জন্য বহুবচন ‘হুম’ (هم) ব্যবহৃত হয়েছে। যেটা হবার কথা ছিল ‘হুমা’ (هما)।
(৭) فإن لم يكن له ولد وورثه أبواه فلأمه الثلث فإن كان له إخوة فلأمه السدس
“কিন্তু তার যদি সন্তান না থাকে ও তার ওয়ারিশ হয় পিতামাতা, তবে তার মাতার জন্য এক-তৃতীয়াংশ, কিন্তু যদি তার ভাইরা থাকে তবে তার মায়ের জন্য ছয় ভাগের একভাগ…” (নিসা/১১)
এখানে বলা হচ্ছে যদি মাইয়্যিতের কোন সন্তান না থাকে, তবে তার ভাই আছে এ ক্ষেত্রে মাইয়্যিতের মা এক ষষ্ঠাংশের মালিক হবে। ফরায়েয বিশেষজ্ঞরা এ কথার উপর একমত যে এখানে যদি নিঃসন্তান মাইয়্যিতের মাত্র দুটি ভাইও হয়, তাহলেও মা এক ষষ্ঠমাংশ পাবে। কিন্তু যারা বলে বহুবচনের জন্য ফর্দ কমপক্ষে ৩(তিন) সংখ্যক হওয়া জরুরী, তাদের ফিলোসফি অনুযায়ী ফরায়েযের এই হিসাব বিশুদ্ধ নয়। কেননা, এখানে ‘ইখওয়াতুন’ (إخوة) তথা বহুবচন ব্যবহৃত হয়েছে। যা তাদের দাবি অনুযায়ী কখনোই ২(দুই) সংখ্যকের জন্য হতে পারে না।
হাদীস থেকে প্রমাণঃ
(১) عن صفية بنت حيي قالت : كان رسول الله صلى الله عليه و سلم معتكفا فأتيته أزوره ليلا فحدثته ثم قمت فانقلبت فقام معي ليقلبني وكان مسكنها في دار أسامة بن زيد فمر رجلان من الأنصار فلما رأيا النبي صلى الله عليه و سلم أسرعا فقال النبي صلى الله عليه و سلم على رسلكما إنها صفية بنت حيي . فقالا سبحان الله يا رسول الله قال إن الشيطان يجري من الإنسان مجرى الدم وإني خشيت أن يقذف في قلوبكما سوءا
“সাফিয়া বিনতে হুয়াই (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুলুল্লাহ (সা.) ই’তিকাফ অবস্থায় ছিলেন। আমি রাতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসলাম। তারপর তাঁর সঙ্গে কিছু কথাবার্তা সারলাম। তারপর আমি চলে আসার জন্য দাঁড়ালাম। তখন রাসুলুল্লাহও (সা.) আমাকে এগিয়ে দেবার জন্য আমার সাথে ওঠে দাঁড়ালেন। তাঁর অবস্থানঘর ছিল উসামা বিন যায়েদের বাড়িতে। এ সময় দু’জন আনসারী ব্যক্তি সে স্থান দিয়ে অতিক্রম করলো। তারা যখন নবী (সা.) কে দেখল তখন তারা দ্রুত চলে যেতে লাগলো। নবী (সা.) তাঁদের বললেন- তোমরা একটু থামো। এ হলো সাফিয়া বিনতে হুয়াই। তারা বললো, সুবহানাল্লাহ হে আল্লাহর রাসুল! তিনি বললেন- মানুষের রক্তধারায় শয়তান প্রবাহমান থাকে। আমি শঙ্কা করছিলাম, না জানি সে তোমাদের মনে কোন খারাপ ধারণা সৃষ্টি করে দেয়।” (বুখারী হা/৩১০৭)
এখানে মাত্র দু’জন সাহাবীর জন্য বহুবচন ‘কুলুব’(قلوب) ব্যবহৃত হয়েছে, যার একবচন হলো ‘কলবুন’ (قلب)। অথচ এ কথা পরিস্কার যে দুইজন ব্যক্তির দুটি কলব রয়েছে।
(২) قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : اثنان فما فوقهما جماعة
“রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- দুইজন বা ততোধিক ব্যক্তি হলেই জামাআত।” (দারাকুতনী হা/২)
হানাফী ফিকহ থেকেঃ
قال إن أقل الجمع اثنان وإن كان المشهور أنه ثلاثة
“ইমাম সুবকী (রহ.) বলেন- বহুবচনের সর্বনিম্ন সংখ্যা হলো দুই, যদিও তিন প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।” (আল ইশবাহ ওয়ান নাযায়ের ১/৫৪ মা.শা.)
অতএব, আরবী ব্যাকরণে বহুবচনের সর্বনিম্ন সংখ্যা ৩(তিন) এ কথা অকাট্য নয়। আমরা কুরআন থেকে, হাদীস থেকে এমনকি হানাফী ফিকহ থেকে পর্যন্ত প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে বহুবচনের সর্বনিম্ন সংখ্যা ২(দুই)ও হতে পারে। এখন যারা ব্যাকরন ‘বেশি বুঝি’ ‘বেশি বুঝি’ বলে লাফাচ্ছে তারা কুরআনের ঐ আয়াতগুলো কি রকম বুঝেছে তাও ভাববার বিষয়। কথায় আছে না, ব্যঙ মনে করে কুয়াটাই তার দুনিয়া। আল্লাহ আমাদের সকলকে হকের উপর অবিচল রাখুন। আমীন।