মনস্টার মেরে নিজের আগমনী ঘোষণা করতে হলে সামনে মনস্টার থাকতে হয়। কাজী নজরুল ইসলামের সামনে অপ্রতিরোধ্য এক মনস্টার ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যার সুরজালকে অতিক্রম করা যায় না, যার আকাশ সকল মাথাকে ঢেকে ফেলে।
প্রথমবার কাজী নজরুল ইসলাম হায়দরী হাক মেরে এ আকাশকে অতিক্রম করলেন । এ সুরজালকে ছিন্ন করে বের হয়ে এলেন, গাজনের বাজনা বাজিয়ে!
তিনি সেই কবি, রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাতে সরাসরি বলেছিলেন , আমি আপনাকে হত্যা করবো। হত্যা করেছিলেন বটে, অবসান এনেছিলেন একক রবীন্দ্রআধিপত্যের।
কিন্তু কী দিয়ে? চপলতা দিয়ে? আবেগ দিয়ে? সস্তাবাজি দিয়ে?
কাজীর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ পুরনো এবং যারা এ অভিযোগ করেন, তারাও মানেন, কাজী রবীন্দ্রবলয়কে অতিক্রম করা প্রথম মুক্ত-স্বাধীন কবি!
যদি তাই হবে, তাহলে নিছক চপলতা ও হুজুগ দিয়ে এই মুৃক্তি , এই স্বাধীনতা নিশ্চিত হয় কীভাবে?
বস্তুত তাদের দ্বিতীয় বক্তব্য প্রথম বক্তব্যকে খারিজ করে দেয় এবং এখানে ধরা খেয়ে যান বুদ্ধদেব বসু।
বুদ্ধদেব দেখাতে চেয়েছিলেন, কাজী নজরুল চপলতা সর্বস্ব ছিলেন । যখনই তিনি চিন্তা করতেন, শিশু হয়ে যেতেন।
এর মানে পরিষ্কার। পরিণত কোনো চিন্তা কাজী কবির মধ্যে ছিলো না। যদি তাই হতো, যুগের হুজুগ কেটে গেলে কাজী নজরুলের নিশ্চিত অবসান আমরা দেখতাম।
কিন্তু সত্য হলো, পরিণত ও গভীরতরো জীবনাবেদনে ঋদ্ধ কবিতার কারণেই কাজী নজরুল নিজ সময়ের কোলাহল স্থিমিত হবার পরেও সমান মাত্রায় আবেদনময়। এ আবেদন কী কাব্যপ্রকরণে, কী বাণীমহিমায়।
সেই কাব্যঋদ্ধি ও বাণীমহিমা এতো প্রবল প্রখর যে, পরবর্তী বাংলা কবিতায় কাজীর সার্বভৌম সাম্রাজ্য হয়ে ওঠে প্রধান এক বাস্তবতা।
কেন নয়? দেখেন, কতো ধারায় বয়ে গেছে কাজীর প্রভাব। জীবনান্দ দাশ বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি। তিনি কাজীকে আত্মস্ত করে শুরু করেন যাত্রা। তার প্রথম কাব্য কাজীময়।
সুকান্ত ভট্টাচার্য কবি হিসেবে আপন কালের প্রতিনিধি। তার সুরে ও অন্তসারে নিনাদিত থেকেছে কাজীর কণ্ঠস্বর। তার থেকে কতো আলাদা কবি ফররুখ আহমদ। তিনিও বাংলাকাব্যের এক অজর রূপকার। তার কাব্যের দেহে ও মনে বেজেছে কাজীর প্রতিধ্বনি।
একদিকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের দিকে তাকান, অপরদিকে বিপ্লবী বেনজির আহমদের দিকে, একদিকে সিকান্দার আবু জাফরের প্রতি তাকান, অপরদিকে দিলওয়ার , রফিক আজাদ কিংবা রুদ্র মহম্মদ শহীদুল্লাহর দিকে, কাজীর প্রভাব প্রত্যেকের কবিতার অন্ত:স্রোতে ঢেউ তুলেছে।
বাংলায় প্রতিবাদে, যুদ্ধে, সংগ্রামে, রাজনীতিতে, ঐক্যে ,দ্বন্দ্বে , উত্সবে, ভক্তিতে, প্রেমে, প্রকৃতিতে, বিষাদে, বিরহে নজরুল মিশে আছেন , ঠিক যেভাবে ধান খেতে মিশে থাকে সূর্যের দুধ!
এতো বহুমাত্রায় নিজের কাব্যিক প্রতিপত্তিকে শতাব্দীর ওপারেও জারি রাখতে সক্ষম কবি রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আরেকজন নেই বাংলা ভাষায়। জীবনানন্দ দাশের প্রভাবের প্রাবল্য মনে রেখেও কথাটি বলছি।
আজকের সাম্রাজ্যবাদকবলিত বিশ্ববাস্তবতায় মুক্তিকামী মানুষের সাপেক্ষে কাজীর আবেদন ও কার্যকরিতা রবীঠাকুরের চেয়েও বেশি।
ঠাকুরের বিশালতার আকাশ অন্যত্র। তাঁর আকাশ বিপুল, বর্ণিল, মায়ামন্ত্রী মাদকতায় গীতিময়। জীবনের লীলায়িত অন্তর্পাঠ রবীন্দ্রনাথের জাদুভরা বাণীভাষ্যে যেভাবে ছন্দিত ও মন্দ্রিত হয়েছে , তা শুধু বাংলার নয়, সর্বজনের চিত্তচারী। রবীন্দ্রনাথের পথ মর্ত্য থেকে উপরের দিকে উঠে গেছে। নজরুলের পথ উপর থেকে মর্ত্যে নেমে এসছে।
নজরুল এখানে ধুলোলিপ্ত , লড়াইমগ্ন , ধ্যানী ও রক্তাক্ত। তাঁর অভিমুখ জীবন-মৃত্যুর তুমুল তীব্রতায়। বহুরূপী বেইনসাফী, ভণ্ডামি আর সাম্রাজ্যবাদ-কবলিত মানুষের মুক্তির রণাঙ্গণে কাজীর অনিবার্যতা সবসময় নবনবীন।
পুঁজিবাদ, পরস্বত্তহরণবাদ, ঔপনিবেশিকতা ও মানুষের উপর লুঠমারের এ বিশ্বে কাজীকবি শুধু বাংলার নয়, গোটা দুনিয়ার প্রেক্ষিতে প্রধান এক কবি।
বিশশতকে বাংলাভাষার কবি হিসেবে লোকান্তরীত হয়ে একুশ শতকে কাজী নজরুল জন্মগ্রহণ করেছেন বিশ্বলোকের মুক্তিমন্ত্রের কবি হিসেবে।
হায় হুমায়ুন আজাদ, তিনি কাজী নজরুলকে কবি মানতেই রাজী নন, তাচ্ছিল্য করে লিখেছিলেন , মহাপদ্যকার! সুন্দরের বিরুদ্ধে এটা ছিলো তার অক্ষম দাপাদাপি!
কাজীর সার্ভভৌম সাম্রাজ্য এখন আরো বাস্তব, আরো প্রসারিত!