জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অনুমোদিত একাদশ শ্রেণীর ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বইটি দেখার সুযোগ হলো। বোর্ড কর্তৃক একাধিক পুস্তক অনুমোদিত হলেও আমি দেখেছি অক্ষরপত্র প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান ও ড. এ টি এম সামছুজ্জোহা সাহেবের লিখিত বইটি। তারা দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ অধ্যাপনা করছেন। পড়াশোনাও করেছেন ইসলামের ইতিহাস নিয়ে।
বাংলাদেশে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ইসলামের ইতিহাস লেখেন ও পড়ান তাদের সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা হলো এই ভদ্রলোকদের পড়াশোনা খুবই কম। ইনারা পি কে হিট্টি ও আমির আলির বাইরে আর কোনো বই জীবনে খুলেও দেখেন না। ইসলামি ইতিহাসের মূল মাসাদির থেকে তথ্য নেয়া দূরে থাক, বেশিরভাগ মাসাদিরের নামও তারা ভালোমত শোনেননি। মাহবুবুর রহমান নামে এক ভদ্রলোক অনার্স লেভেলের জন্য ইতিহাসের বহু বইপত্র লিখে ফেলেছেন। ভদ্রলোকের জানাশোনার এমন অবস্থা যে এই জ্ঞান নিয়ে পিএইচডি দূরে থাক সামান্য একটা প্রবন্ধ লিখেও সেটা মানোত্তির্ন করা সম্ভব নয় উনার পক্ষে।
আমাদের দূর্ভাগ্য, ড. আহমদ আলি স্যারের মত যোগ্য মানুষদের পরিবর্তে এমন অর্ধেক পড়ুয়া গবেষকের লেখাজোঁকা পড়তে হচ্ছে ছাত্রদের। অথচ এদের লেখা পড়ার চেয়ে ব্রিলের বইপত্র পড়া অনেক ভালো। ইসলামি ইতিহাস পড়ুয়া অনেকের সাথে কথা বলে দেখেছি, ইসলাম সম্পর্কে তাদের জানাশোনা ভয়ংকর ধরণের বিকৃত। সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে তাদের মনে খেলা করে ভয়াবহ বেয়াদবি। এসবই এমন আধপড়ুয়া গবেষকদের লেখা পড়ার কুফল।
ছিদ্দিকুর রহমান ও সামছুজ্জোহা সাহেবের বইটিও একই সমস্যাযুক্ত। পুরো বইয়ে ইতিহাসের কাঠামো নির্মানে তারা সামনে রেখেছেন পি কে হিট্টি ও আমির আলির বই দুটি। মাঝে মাঝে জোড়াতালি দিয়েছেন এখান সেখান থেকে। ইসলামের ইতিহাসের বই নাম হলেও এখানে অনুপস্থিত মুসলিম ইতিহাসবিদদের উদ্ধৃতি। ফলে দুই বছর ইসলামের ইতিহাস পড়েও ১০ জন মুসলিম ইতিহাসবিদের নাম জানবে না কেউ। এই দুই লেখকের পড়াশোনার লেভেল এতটাই হাস্যকর যে বুখারির হাদিসকেও উদ্ধৃত করেছেন উইলিয়ার ম্যুরের মত চরম ইসলাম বিদ্বেষী লেখকের বই থেকে। আয়েশা রা থেকে বর্নিত হাদিসের রেফারেন্স দিয়েছেন হিট্টির বই থেকে।
পুরো বইটি ধরে ধরে রিভিউ করা সময়সাপেক্ষ। আপাতত কিছু নমুনা তুলে দিচ্ছি যা থেকে বোঝা যাবে ইসলামের ইতিহাসের নামে কী বিষ গেলানো হচ্ছে ছাত্রদের।
নমুনা ১
১০৩ পৃষ্ঠায় নবিজির যুগে মদিনার শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে লেখা হয়েছে, মদিনা ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি ধর্মীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। দু লাইন পরে আবার লেখা হয়েছে এটি ছিল ইসলামি রাষ্ট্র এবং ইসলামি রাষ্ট্রে আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য আইন চলে না। পরের পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে নবিজি ঐশিতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সমন্বয়ে একটি কার্যকর শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ১০৮ পৃষ্ঠায় আছে, প্রাচীন গ্রিসে গণতন্ত্রের সূচনা হয়েছিল। মহানবী মুহাম্মদ স এর গৃহীত পদক্ষেপ সেই গণতন্ত্রের ধারণাকে আরো শক্তিশালী করে। (নাউযুবিল্লাহ)
নমুনা ২
১৩২ পৃষ্ঠায় খিলাফতের সংজ্ঞার জন্য উদ্ধৃত করা হয়েছে খ্রিস্টান লেখক জুরজি যায়দানকে। লেখকদ্বয় তার পরিচয় দিয়েছেন আরব ঔপন্যাসিক বলে। এর চেয়ে হাস্যকর বিষয় কী হতে পারে। ১৩৩ পৃষ্ঠায় আছে খিলাফতে রাশেদার নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পূর্ন গণতান্ত্রিক ছিল। ১৪২ পৃষ্ঠায় আছে আবু বকর রা ছিলেন গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক। তিনি প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকারের গোড়াপত্তন করেন। ১৬১ পৃষ্ঠায় আছে, উমর রা সম্পূর্নরুপে ছিলেন গনতন্ত্রমনা। তার মতে গণতন্ত্র ছাড়া কোনো রাষ্ট্র চলা উচিত নয়। (নাউযুবিল্লাহ)। মহানবী মদিনায় গণতন্ত্রের যে বীজ বপন করেন তা হজরত উমর (রা) এর নীতিতে এক শক্তিশালী মহীরুহে পরিণত হয়েছিল। ১৭০ পৃষ্ঠায় আছে, আবু বকর (রা) এর সময় থেকে খিলাফতে গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। হজরত উসমানের হত্যাকাণ্ডের ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ইতি ঘটে।
মন্তব্য - দুই লেখক না বুঝেছেন ইসলামি খেলাফতের কাঠামো, না বুঝেছেন গণতন্ত্র। নিজে পড়াশোনা না করে হিট্টির চোখ দিয়ে ইসলামের ইতিহাস বুঝতে গেলে এমন চোরাবালিতে হাবুডুবু খেতে হবেই।
নমুনা ৩ (সাহাবা-বিদ্বেষ)
১। ১৭৫ পৃষ্ঠায় আছে, সৈয়দ আমির আলি বলেন, আবু বকরের কন্যা আয়েশা আলির প্রতি সীমাহীন বিদ্বেষ পোষণ করায় তিনিও বিদ্রোহ উস্কে দিয়েছেন। (নাউযুবিল্লাহ) পরের পৃষ্ঠায় আয়েশা রা এর বিদ্বেষ শিরোনামে বিশাল প্যারা লেখা হয়েছে। সেখানে আমির আলি ও উইলিয়ার ম্যুরের বক্তব্য উদ্ধৃত করার পর লেখক জানাচ্ছেন, আয়েশা রা আসলে বিদ্বেষের কারণে খলিফার বিরোধিতা করেননি।
মন্তব্য - লেখকদ্বয় যদি আমির আলি ও উইলিয়াম ম্যুরের দাবির সাথে একমত না হন, তাহলে তাদের বক্তব্য উদ্ধৃত করার মানে কী? আয়েশা রা এর বিদ্বেষ শিরোনামে আলাদা পয়েন্ট আনার মানে কী?
২। ১৭৮ পৃষ্ঠায় আছে, মুয়াবিয়া ছিলেন অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী ও ক্ষমতালিপ্সু। ১৭৯ পৃষ্ঠায় আনা হয়েছে জংগে সিফফিনের বানোয়াট ঘটনা যেখানে দেখা যায় মুয়াবিয়া রা এর বাহিনী বর্শার মাথায় কোরআনুল কারিম গেঁথে রেখেছিল। এরপর আনা হয়েছে সালিশি বৈঠকের বানোয়াট ঘটনা যেখানে আমর ইবনুল আস প্রতারণা করেন। লেখকদ্বয় জানাচ্ছেন, আমর ইবনুল আসের ভূমিকা ছিল ধূর্ততা ও শঠতার এক জ্বাজল্যমান উদাহরণ। (নাউযুবিল্লাহ)
৩। ১৮৬ পৃষ্ঠায় আলি রা কে অদূরদর্শি ও ব্যর্থ খলিফা বলা হয়েছে। ২১৪ পৃষ্ঠায় মুয়াবিয়া রা কে উদ্ধত ও শঠ বলা হয়েছে। আমর ইবনুল আসকে বিশ্বাসঘাতক ও ধূর্ত বলা হয়েছে। ২২০ পৃষ্ঠায় আছে মুয়াবিয়া রা ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন এজন্য তিনি খ্রিস্টান মেয়েকেও বিবাহ করেন। ২২১ পৃষ্ঠায় আছে, মুয়াবিয়া রা শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেন। (নাউযুবিল্লাহ) ২২৪ পৃষ্ঠায় আছে মুয়াবিয়া রা ছিলেন কপট ও স্বার্থান্বেষী। এরপর বলা হয়েছে তার মাঝে ছিল শঠতা ও প্রতারণা।
৪। ২২৫ ও ২২৫ পৃষ্ঠায় আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইরকে স্বার্থান্বেষী ও ষড়যন্ত্রকারী বলা হয়েছে। তিনি ক্ষমতার পথ থেকে সরাতে হুসাইন রা কে উস্কানি দিয়ে কুফায় পাঠান বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
নমুনা ৪
২৩৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইরের প্রতি বিদ্বেষ করে কুব্বাতুস সাখরা নির্মান করেন এবং লোকজনকে নির্দেশ দেন সেখানে হজ্ব করতে।
মন্তব্য - লেখকদ্বয় এখানে কোনো রেফারেন্স না দিলেও আমরা জানি এটা কার কথা। চরমপন্থি ইমামিয়া শিয়া ইয়াকুবির লেখা তারিখে ইয়াকুবি ছাড়া আর কোথাও এই বানোয়াট বর্ননার অস্তিত্ব নেই। লেখকদ্বয় তারিখে ইয়াকুবি দেখার পরিশ্রম করেছেন এমন অপবাদ দিব না, কারণ হিট্টি তার বইতে এই বর্ননা এনে উনাদের পরিশ্রম কমিয়েছেন।
এখানে অল্পকিছু নমুনা উদ্ধৃত করেই ক্ষান্ত হচ্ছি। পুরো বইয়ে এমন আরো নানা সমস্যা আছে। দ্বিতীয় পত্র এখনো দেখিনি। সেই অংশটিও এমন সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়ার কথা নয়। এ বিষয়ে অন্য যেসব বই আছে সেগুলোও যে এ ধরণের বিদঘুটে তথ্যে ভরপুর তা অনেকটা অনুমান করা যায়। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা না করে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস পড়ুয়া ছাত্র ও এ সংশ্লিষ্ট অন্যদের কিছু অনুরোধ করবো।
ছাত্রদের প্রতি
আপনারা যারা ইসলামের ইতিহাস পড়া শুরু করেছেন, আপনারা কোনো আলেমের তত্ত্বাবধানে আকিদাতুত তহাবিয়্যার মূল টেক্সট পড়ে ফেলুন। এরপর মাওলানা ইসমাইল রেহানের মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস এর প্রথম খণ্ডে বর্নিত ইতিহাসের মূলনীতিগুলো পড়ুন। সেগুলো আয়ত্ত করুন। মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস আগাগোড়া একবার পড়ুন ও মাথায় রাখুন। এরপর এসব পাঠ্যপুস্তক পড়ুন। মূলনীতিগুলো মাথায় রাখুন। আকিদা ও ইতিহাসের বিপরীত কিছু সামনে এলে আলেমদের সাথে কথা বলুন।
অভিভাবকদের প্রতি
আপনাদের সন্তান বা নিকটাত্মীয় যারা ইসলামের ইতিহাস পড়ছে বা পড়বে তাদের সাথে পাঠ্যপুস্তকের সমস্যা ও ইসলামি ইতিহাস পাঠের মূলনীতি সম্পর্কে আলোচনা করুন।
তরুণ আলেম ও তালিবুল ইলমদের প্রতি
আপনারা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামের ইতিহাসের যেসব বই পাঠ্য সেগুলোকে ধরে ধরে পর্যালোচনা করুন। এর সমস্যা চিহ্নিত করুন। আলিয়ার বইকেও বাদ দিবেন না। এগুলো চিহ্নিত করে সবগুলো বইয়ের উপর পর্যালোচনা করুন। পর্যালোচনাগুলো পিডিএফ করে ছেড়ে দিন। যেন ছাত্রদেরকে সহজে সরবরাহ করা যায়। পরিচিত মহলে বিষয়গুলো আলোচনা করুন। মানুষকে সতর্ক করুন।
প্রকাশকদের প্রতি
ইতিহাস সংক্রান্ত বইয়ে নানা ধরণের সংশয় ছড়ালেও আপাতত সিরাত, খোলাফায়ে রাশেদিন ও উমাইয়া শাসন নিয়ে ছড়ানো সংশয়গুলো রদ করা জরুরি। এ বিষয়ে আপনারা সংক্ষিপ্ত কোনো বই আনুন যেখানে প্রচলিত সিলেবাসের এসব ভুল সহজবোধ্য ও দালিলিক ভাষায় চিহ্নিত করে সমাধান বাতলে দেয়া হবে। প্রয়োজনে নবিন-প্রবীন একাধিক আলেমের সমন্বয় করে কাজটি করা হোক।
* ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ১ম পত্র; সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা – ইমরান রাইহান