বঙ্গবীর ঈসা খাঁঃ এর অজানা ইতিহাস

বঙ্গবীর ঈসা খাঁঃ  বাংলার প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক 

১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান দাঊদ খান কররানীকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে বাংলায় মুঘল শাসনের সূত্রপাত করেন সম্রাট জালালউদ্দিন মুহম্মদ আকবর  এবং বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে  পরিণত হয়। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রদেশসমূহকে 'সুবা' বলা হতো এবং  মুঘল সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত প্রাদেশিক গভর্নরকে বলা হতো সুবাদার। সুবাদারগণ মুঘল বাদশাহর প্রতিনিধি  হিসেবে  প্রদেশের শাসনকার্য পরিচালনা  করতেন।  

১৫৭৬ সালে আকবর বাংলা  বিজয়  করলেও সমগ্র  বাংলার  উপর তিনি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা  করতে পারেন নি। আকবর মূলত বর্তমান  পশ্চিমবঙ্গে এবং পূর্ব বঙ্গের সামান্য কিছু অঞ্চলে  নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন ; প্রায় সমগ্র পূর্ব বঙ্গই ছিলো মুঘল নিয়ন্ত্রণের বাইরে । পূর্ব বাংলার বড় বড় অঞ্চলের জমিদাররা একজোট হয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান ও মুঘলদের প্রতিরোধ করা শুরু  করেন ।  পূর্ব বঙ্গের প্রতাপশালী জমিদাররা নিজেদের জমিদারিতে স্বাধীন ছিলেন,  তাঁরা মুঘলদের কর দিতেন না ও মুঘল বাদশাহর আনুগত্যও স্বীকার করতেন না ; তাঁরা একজোট হয়ে মুঘল সেনাপতির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বাংলা কে মুঘল নিয়ন্ত্রণ থেকে এভাবেই রক্ষা করার প্রচেষ্টা করে যান বাংলার এই বীর জমিদাররা -- ইতিহাসে তাঁরা  'বারো ভূঁইয়া' নামে খ্যাত। অনেকের মতে বারো ভূঁইয়া বলতে ১২ জন শক্তিশালী জমিদারকে বোঝায় ; আবার অনেকের মতে  'বারো ভূঁইয়া' কথাটি দ্বারা নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা বোঝানো হয় না। বারো ভূঁইয়াদের প্রধান ছিলেন সোনারগাঁওয়ের জমিদার ঈসা খাঁ (১৫২৯-১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দ)। বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা ছিলেন ঈসা খাঁ, ঈসা খাঁর পুত্র। মুসা  খাঁ, রাজা প্রতাপাদিত্য,  কেদার রায়, চাঁদ রায়, ফজল গাজী , রামকৃষ্ণ, পীতম্বর প্রমুখ। 

ঈসা খাঁ (১৫২৯-১৫৯৯) 

 ঈসা খাঁর পিতামহ ভাগীরথ ছিলেন রাজপুত জাতির একজন ব্যক্তি। তিনি ভাগ্যান্বেষণের লক্ষ্যে অযোধ্যা থেকে বাংলায় এসেছিলেন। ভাগীরথ নিজ মেধা ও যোগ্যতাবলে  বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের অধীনে প্রশাসনিক কার্যে নিয়োজিত হন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে জমিদারিপ্রাপ্ত হন। ভাগীরথের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গজদানি কালিদাস সিংহ পিতার জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং নিজ  যোগ্যতাবলে সুলতানের রাজদরবারে  রাজস্বমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন। গজদানি কালিদাস সিংহ সূফী সাধক ইব্রাহিম দানিশমান্দ (রহ.)-এর  শিষ্যত্ব গ্রহণপূর্বক ইসলাম গ্রহণ করেন ও নিজের নামকরণ করেন সুলায়মান খাঁ। সুলায়মান খাঁয়ের সাথে হোসেন শাহী রাজবংশের শেষ সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের মেয়ে শাহজাদি সৈয়দা মোমেনা খাতুনের বিবাহ হয় ও এভাবে সুলায়মান খাঁর শক্তি বৃদ্ধি ঘটে। এই সৈয়দা মোমেনা খাতুনের গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেন  বাংলার প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের সিপাহসালার  ঈসা খাঁ। 

১৫৩৮ সালে হুমায়ুন প্রথম মুঘল বাদশাহ হিসেবে বাংলা বিজয়ের জন্য অভিযান পরিচালনা করেন এবং রাজধানী গৌড় দখল করেন। তিনি আটমাস বাংলায় অবস্থান করেন এবং এরপর ১৫৩৯ সালে দিল্লি ফেরার পথে বক্সারের নিকটবর্তী চৌসার নামক স্থানে বিহারের  গভর্নর শেরখান শূরের অতর্কিত আক্রমণে পড়েন। ১৫৩৯ সালে চৌসারের যুদ্ধে সম্রাট হুমায়ুন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে কোনো মতে প্রাণ নিয়ে দিল্লিতে পলায়ন করেন। শেরখান শূর 'শেরশাহ' উপাধি ধারণ করেন ও নিজেকে বিহারের স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করেন। 

১৫৪০ সালে শেরশাহ বাংলা দখল করেন এবং একই বছর কানৌজের নিকট বিলগ্রামের যুদ্ধে শেরশাহ হুমায়ুন কে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন দখল করেন এবং ভারতীয় উপমহাদেশে শূর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চলই শেরশাহের অধীনে আসে এবং এভাবেই আফগান নেতা শের শাহ ভারতবর্ষে

আফগান শাসন প্রতিষ্ঠা করেন, যা স্থায়ী ছিলো ১৫৫৫  সাল  পর্যন্ত। ১৫৪৫ সালে শেরশাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জালাল খান ইসলাম শাহ নাম ধারণ করে শূরী সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং বাংলার উপর সম্পূর্ণভাবে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন।  তখন সরাইলের জমিদার সুলায়মান খাঁ বাংলার উপর আফগান শূরীদের কর্তৃত্ব  অস্বীকার  করেন এবং হোসেন শাহী রাজবংশের শেষ সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের জামাতা হিসেবে বাংলার মসনদের উত্তরাধিকার দাবি করেন। এ নিয়ে ইসলাম শাহ শূরীর সাথে সুলায়মান খাঁ এর দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় ও ইসলাম শাহ শূরী ও সুলায়মান খাঁ এর মধ্যে যুদ্ধ হয়। সুলায়মান খাঁ এই যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন এবং তাঁর দুই ছেলে ঈসা ও ইসমাইলকে ইরানি বণিকদের নিকট বিক্রি করে দেয়া হয়। ঈসা খাঁর  চাচা কুতুব খাঁ রাজকার্যে নিযুক্তি লাভ করে বহু অর্থের বিনিময়ে বহু কষ্টে  ইরানি বণিকদের থেকে ঈসা কে মুক্ত করে আনতে সক্ষম হন।

তাজ খান কররানী বাংলার সুলতান হিসেবে অধিষ্ঠিত হবার পর ঈসা খাঁ পিতার জমিদারী ফিরে পান এবং তাঁর জমিদারীর দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তিনি শুরু থেকেই মুঘলদের তীব্র বিরোধিতা করেন ও আফগান বংশোদ্ভুত কররানী রাজবংশের সুলতানদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা ও বাংলার সুলতানদের সহযোগী হিসেবে  শক্তি প্রয়োগ শুরু  করেন। ঈসা খাঁ আফগান দলপতি ও স্থানীয় জমিদারদের সংগঠিত করা শুরু করেন মুঘলদের প্রতিহত করার জন্য। 

১৫৭৬ সালে মুঘল সাম্রাজ্য ও বাংলা সালতানাতের মধ্যে সংঘটিত চূড়ান্ত যুদ্ধে (রাজমহলের যুদ্ধ) বাংলার সুলতান দাঊদ খান কররানী নিহত হন , নিহত হন দুর্ধর্ষ সেনাপতি কালাপাহাড় এবং এরই মধ্য দিয়ে পতন ঘটে স্বাধীন সুলতানি যুগের। বাংলা পরিণত হয় মুঘল সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে বা সুবায়। 

পূর্ববঙ্গের বড় বড় অঞ্চলের জমিদাররা মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে যান এবং মুঘলদের একপ্রকার নাজেহাল করেই ছাড়েন। ঈসা খাঁ মুঘলদের প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে কামরূপ ও ত্রিপুরার রাজার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। তিনি বেশ কয়েকটি যুদ্ধে মুঘলদের পরাজিত করেন এবং সরাইল থেকে রংপুর, কিশোরগঞ্জ থেকে সোনারগাঁও পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলকে মোঘল আধিপত্য মুক্ত রাখেন।তিনি মুঘল সুবাদার শাহবাজ খানকে পরাজিত করেছিলেন। ১৫৮৮ সালে ঈসা খাঁ কেদার রায়ের ভাইঝি স্বর্ণময়ী (ঈসা খাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী সোনাবিবি) কে অপহরণ করে বিয়ে করলে তাঁর সাথে আরেক বারোভূঁইয়া বিক্রমপুরের জমিদার কেদার রায়ের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ঈসা খাঁর খিজিরপুর দুর্গ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো কিন্তু মসনদ-ই আলার প্রবল শক্তির সামনে টিকতে পারেনি কেদার রায়। এই যুদ্ধে ঈসা খাঁর কাছে পরাজিত হবার কয়দিন পর কেদার রায়ের ভাই চাঁদ রায় মৃত্যুবরণ করে।

 ঈসা খাঁর বীরত্বের জন্য  সুলতান দাঊদ খান কররানী তাঁকে 'মসনদ-ই-আলা' উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।

 মুঘল সম্রাট আকবর বাধ্য হয়ে ১৫৯৪

সালে  রাজা মান সিংহকে পাঠান ঈসা খাঁকে দমন করার জন্য। রাজা মানসিংহ ঈসা খাঁর দ্বিতীয় রাজধানী কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার এগারসিন্ধুর দুর্গ আক্রমণ করলে ঈসা খাঁ দ্রুত তাঁর মিত্রবাহিনী ও অসংখ্য রণতরী সহ সোনারগাঁও থেকে কিশোরগঞ্জে আসেন এবং  মানসিংহকে পরাজিত করেন। 

সাথে অনুষ্ঠিত ঈসা খাঁর যুদ্ধে মান সিংহের ছেলে দুর্জয় সিংহ নিহত হন। শেষে মান সিংহ ও ঈসা খাঁ'র ভেতর একটি সমঝোতা হয় ।বলা হয়,    মানসিংহ ও ঈসা খাঁ দুজনের মধ্যে তলোয়ার যুদ্ধ সংঘটিত হবে -- যে জয়ী হবে সেই বাংলা শাসন করবে। যুদ্ধ শুরু হলে তলোয়ারের প্রথম আঘাতেই ঈসা খাঁ মান সিংহের তরবারি দ্বি-খণ্ডিত  করে  ফেলেন। কিন্তু ঈসা খাঁ তাঁকে হত্যা না করে তাঁকে আরেকটি তরবারি গ্রহণের আমন্ত্রণ জানান। ঈসা  খাঁ'র এই মহানুভবতায়  মুগ্ধ হয়ে মান সিংহ ঈসা খাঁর সাথে লড়াই না করে তাঁকে আলিঙ্গন করেন ও বাদশাহ আকবরের কাছে ঈসা খাঁর বিশেষ প্রশংসা করেন। কথিত আছে যে, ঈসা খাঁ রাজা মান সিংহের সঙ্গে দিল্লিতে বাদশাহ আকবরের রাজসভায় উপস্থিত হন ও সম্রাট তাঁকে বিশেষ সমাদর করেছিলেন। 

১৫৯৯ সালে  তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর পুত্র মুসা খাঁ বারো ভূঁইয়াদের নেতা হন। 

১৬১০ সালে বাদশাহ সেলিম নূর উদ্দিন মুহম্মদ জাহাঙ্গীরের শাসনামলে বাংলার সুবাদার ইসলাম খান মুসা খাঁ কে পরাজিত করার মাধ্যমে খান বারো ভূঁইয়াদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন। মুসা খাঁ পরাজিত হলে অন্যান্য জমিদাররা মুঘল কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। সুবাদার ইসলাম খান পূর্ববঙ্গে মুঘল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ১৬১০ সালে  বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করেন। সম্রাটের নামানুসারে তিনি ঢাকার নামকরণ করেন জাহাঙ্গীরনগর। এভাবেই ঢাকা শহরের প্রতিষ্ঠা করেন সুবাদার ইসলাম খান। তিনি 'দোলাই খাল' খনন করেছিলেন। 

মুসা খাঁ বারো ভূঁইয়াদের নিকট পরাজিত হবার পর তিনি মুঘল আনুগত্য স্বীকার করে নেন এবং দিউয়ান হিসেবে নিজ জমিদারিতে বহাল থাকেন। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল হিসেবে আসাম যুদ্ধ সহ কয়েকটি অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঈসা খাঁর বংশধররা নিজ জমিদারিতে মুঘল শাসনামলে বহাল ছিলেন। 

তথ্যসূত্রঃ

০১. বাংলায় ইসলামের আবির্ভাব ও বিকাশ এবং একটি নতুন ধারার গোড়াপত্তন - মোহাম্মদ ইউসুফ সিদ্দিক

০২. বাংলার বারো ভূঁইয়া সমাচার-শেখ মাসুম কামাল

০৩. আইন-ই-আকবরী - আবুল ফজল

০৪. পৃথিবীর ইতিহাস - চতুর্থ খণ্ড (দুর্গাদাস লাহিড়ী) ২৫৮ পৃষ্ঠা

Read Also :

Getting Info...

Post a Comment

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.