মীর্জা নাথনের বর্ণনা থেকে সেযুগের ঈদ-উৎসব সম্বন্ধে একটি ধারণা পাওয়া যায়। খুব আমোদ-স্ফূর্তির সঙ্গে ঈদের নতুন চাঁদকে স্বাগত জানানো হয়। মীর্জা নাথনের ভাষায় এটা বর্ণনা করা যেতে পারে; তিনি লিখেছেন, “দিনের শেষে সন্ধ্যা সমাগমে নতুন চাঁদ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজকীয় নাকারা বেজে উঠে এবং গোলন্দাজ সেনাদলের সকল আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ক্রমাগত তোপ দাগানো হয়। রাত্রির শেষভাগে, কামানের অগ্নদগীরণ শেষ হয় এবং এর পর শোনা যায় ভারি কামানের আওয়াজ। এটা ছিল দস্তুরমতো একটা ভূমিকম্প।”
এথেকে বুঝা যায়, ঈদের আগমনে মুসলমানরা কত খুশি হতো। ঈদের দিনে সমস্ত মুসলমান আনন্দ স্ফূর্তিতে মসগুল থাকত। স্ত্রী পুরুষ, বালক বালিকা নির্বিশেষে প্রত্যেকে নতুন এবং উৎকৃষ্ট কাপড় পরিধান করত। চমৎকার পোশাক পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে মুসলমানগণ প্রভাতে ঈদগাহ্ ময়দান বা ঈদের নামাজের স্থানে শোভাযাত্রা করে গমন করত। অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা পথেপথে টাকা পয়সা ও উপহার দ্রব্য ছড়িয়ে দিত এবং সাধারণ অবস্থার মুসলমানগণ গরিবদেরকে ভিক্ষা দিত। 'নওবাহার-ই-মুর্শিদকুলী খানী' গ্রন্থের লেখক আজাদ হোসেন বিলগ্রামীর বর্ণনায় এর উল্লেখ রয়েছে।
তিনি বলেন যে, নবাব শুজাউদ্দিনের অধীনে ঢাকার সহকারী শাসনকর্তা 'ঈদগাহ ময়দানের দিকে শোভাযাত্রা করে যাওয়ার সময় দুর্গ থেকে এক ক্রোশপথে প্রচুর পরিমাণে টাকাপয়সা ছড়িয়ে যেতেন। এক বড় জামাতে মুসলমানগণ তাদের নামাজ পড়ত এবং আনন্দ আবেগে একে অন্যকে উৎসাহের সঙ্গে অভিবাদন জানাতো। গোলাম হোসেন তাবাতাবাঈয়ের বর্ণনায় ঈদ উৎসবে মুসলমানদের খুশি ও আনন্দস্ফূর্তির বিষয় প্রকাশ পেয়েছে।
তিনি বলেন যে, প্রত্যেকেই এই দিনে উৎকৃষ্ট পোশাকে সজ্জিত হতো। নবাব আলিবর্দীর ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা নওয়াজিশ মুহম্মদ খান তার প্রিয়জনের মৃত্যুতে 'ঈদ- উল-আজহার দিনে নিরানন্দভাবে থাকেন। বৃদ্ধ নবাব তাকে নতুন কাপড় চোপড় পরাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অতঃপর তিনি হারেমের বেগম এবং মহিলাদেরকে ঈদের আনন্দ- উৎসব উপযোগী কাপড় চোপড় নিয়ে তাকে উৎফুল্ল করে তুলতে পরামর্শ দেন।
মুসলমানগণ ত্যাগের উৎসরূপে 'ঈদ-উল-আজহা উদযাপন করে। এর উৎপত্তি হয়েছে পয়গম্বর ইব্রাহীমের সময় থেকে। আল্লাহর উদ্দেশ্যে হয়রত ইব্রাহীম প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কোরবানির আয়োজন করেছেন। মুসলমানগণ এই মহৎ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে।
তারা প্রভাতে সুন্দর কাপড়-চোপড় পরিধান করে এবং তকবীর' উচ্চারণ করতে করতে ঈদগাহ ময়দানের দিকে শোভাযাত্রা করে গমন করে। সেখানে জামাতে তারা নামাজ আদায় করে এবং ভ্রাতৃত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে, পরস্পরকে আলিঙ্গন করে ও সম্ভাষণ জানায়।
অতঃপর তারা গৃহে প্রত্যাবর্তন করে এবং তাদের সাধ্যানুসারে তারা কোনো পশু, যেমন, গরু, ছাগল, মহিষ বা উট কোরবানি করে। তারা গরিব দুঃখী, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে মাংস বিতরণ করে এবং গৃহে ভোজের অনুষ্ঠান করে।
প্রত্যেক গৃহ ভোজানুষ্ঠান ও আনন্দ স্ফূর্তিতে মুখরিত হয়ে উঠে এবং সকল গৃহে আদর আপ্যায়ন চলতে থাকে। শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্যে তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হয় এবং এই মহান উৎসবে তারা সকলে একত্রে আনন্দ করে।
ঈদ-উল-আজহা' উৎসব উদ্যাপনের কথা বলতে গিয়ে মীর্জা নাথন লিখেছেন যে, নামাজান্তে খতিবের খুতবাহ্ পাঠ শেষ হলে, লোকেরা তাকে কাপড়-চোপড় ও টাকাপয়সা উপহার দেয়। গরিব দুঃখীদের সাহায্যের জন্য তার সম্মুখে টাকাপসয়া ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দুঃস্থ লোকদের অনেকে এর দ্বারা তাদের অভাব দূর করে এবং সুখি হয়। পরস্পরের প্রতি সম্ভাষণে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে। “ কোরবানি সম্পন্ন হবার পর বিরাট ভোজের ব্যবস্থা হয়। সুন্দর গায়ক মোহনী নর্তকী এবং নম্র স্বভাবের গল্প কথকদের মধুর আপ্যায়নের সঙ্গে দিনরাত ভোজানুষ্ঠান চলতে থাকে। শিল্প কারখানার বহু শ্রমিককে উপহার সামগ্রী প্রদানে তুষ্ট করা হয়।”
মীর্জা নাথন আরো লিখেছেন “উৎসবের দিনে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও রাজকর্মচারীগণ একে অন্যের জায়গায় গমন করেন এবং ঈদের শুভেচ্ছা জানান। সেনাপতি শাজাত খান আনন্দ উৎসবের এই দিনটিতে বন্ধুবান্ধবদের আপ্যায়নের নিমিত্ত একটি সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।
(বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ২/১৯৫-১৯৭ - এম এ রহিম)