ইসলাম-বিদ্বেষীদের একটি সংশয় ও তার জবাব

ইসলাম-বিদ্বেষী কিছু মানুষ মুসলিম আত্মপরিচয়কে আঘাত করার জন্য বলে, আমাদের আগে বাঙালি তারপর মুসলিম হওয়া দরকার। কারণ বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করার কারণে আমরা প্রাকৃতিকভাবেই বাঙালি জাতীয়তা ধারণ করে নিয়েছি। আমরা চাইলেও আমাদের জাতীয়তা পাল্টাতে করতে পারব না। কিন্তু আমাদের কেউ চাইলে যখন ইচ্ছা তার ধর্ম পরিবর্তন করতে পারবে। এজন্য আমরা আগে বাঙালি তারপর মুসলিম। 

এই ধরনের যুক্তি দেওয়া হয় মূলত মুসলিম ও বাঙালি দুটি আত্মপরিচয়কে মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্য এবং মুসলিমদের আত্মপরিচয় নিয়ে সংকট তৈরির জন্য। এই ধরনের অপযুক্তির জবাবে আমরা বলব : 

প্রথমত, আমরা পূর্বে বিভিন্ন আলোচনায় এটা দেখিয়েছি যে, মানুষের প্রকৃত অবস্থান সে আল্লাহর বান্দা ও মাখলুক। সৃষ্টিগতভাবে সে মুসলিম হিসেবেই জন্মগ্রহণ করে। প্রকৃতপক্ষে কোনো মানুষই তার অস্তিত্বের এই বাস্তবতা পরিবর্তন করতে পারে না। সে নিজ থেকে বা শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়নি। আল্লাহই তাকে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং এই বাস্তবতা কোনো মানুষই পরিবর্তন করতে পারবে না; কিন্তু মানুষ সেটা অস্বীকার করতে পারবে। আর এই অস্বীকার করার কারণেই সে কাফের হয় বা মুসলিম ছাড়া অন্য কোনো পরিচয় ধারণ করে। 

জান্মস্থানের পরিচয় যেমন পরিবর্তন করা যায় না, তেমনই মানুষের প্রকৃত আত্মপরিচয়ও পরিবর্তন করা যায় না। তবে মানুষ চাইলে তার জাতীয়তাকে অস্বীকার করতে পারে, যেমন মানুষ তার আত্মপরিচয়কেও অস্বীকার করতে পারে; কিন্তু পরিবর্তন করতে পারে না। ফলে ওপরে দেওয়া যুক্তি আর টিকছে না। 

দ্বিতীয়ত, আমরা মুসলিম আত্মপরিচয়ের শিকড় অনুসন্ধান করে দেখিয়েছি যে, মানবজাতির সূচনালগ্ন থেকেই মুসলিম আত্মপরিচয়ের সূচনা। এমনকি আরও সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে মানুষ দুনিয়াতে আসার আগেই মুসলিম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে নিজেকে। যেমন রুহের জগতে আল্লাহ তাআলা মানুষ থেকে যে অঙ্গিকার নিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বলেছেন, 

وَ اِذْ اَخَذَ رَبُّكَ مِنْۢ بَنِیْۤ اٰدَمَ مِنْ ظُهُوْرِهِمْ ذُرِّیَّتَهُمْ وَ اَشْهَدَهُمْ عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ اَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ ؕ قَالُوْا بَلٰی ۛۚ شَهِدْنَا ۛۚ اَنْ تَقُوْلُوْا یَوْمَ الْقِیٰمَةِ اِنَّا كُنَّا عَنْ هٰذَا غٰفِلِیْنَۙ

‘আর যখন তোমার পালনকর্তা বনি আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করলেন তাদের সন্তানদেরকে এবং নিজের ওপর তাদেরকে প্রতিজ্ঞা করালেন—আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই? তারা বলল, অবশ্যই, আমরা (এ ব্যাপারে) অঙ্গীকার করছি। (আর এ স্বীকারোক্তি আমি এজন্য নিয়েছিলাম) আবার না কিয়ামতের দিন বলতে শুরু করো যে, এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না।’ [সুরা আরাফ, আয়াত ১৭২] 

এই আয়াত থেকে প্রমাণিত, মানুষ পৃথিবীতে আসার আগেই মুসলিম হিসেবে নিজেকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। এই পরিচয় সে দুনিয়াতে আসার আগেই ধারণ করে। আর তার জাতীয়তা অস্তিত্ব লাভ করে দুনিয়াতে আসার পর। সুতরাং এখান থেকে সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, আমরা আগে মুসলিম তারপর অন্য যেকোনো জাতীয়তা। তা ছাড়া দেখা যাবে, অনেক জাতীয়তার অস্তিত্ব কেবল ৫০ বছর কিংবা ১০০ বছরের। পৃথিবীতে এখন যত রাষ্ট্র আছে, পূর্বে এর অর্ধেকও ছিল না। বিভিন্ন রাষ্ট্র বিভিন্ন কারণে সময়ে সময়ে একটি নতুন নাম ধারণ করে অস্তিত্ব লাভ করেছে।

অন্যদিকে মুসলিম পরিচয় মানবজাতি পৃথিবীতে আসার আগেই অস্তিত্বশীল। পৃথিবীর এসব ভূখণ্ড সৃষ্টিই করা হয়েছে মানবজাতির জন্য। সুতরাং কোনো দিক থেকেই জাতীয়তা মানুষের আত্মপরিচয়ের প্রথম বিষয় হতে পারে না। এটা মানুষের শাখাগত পরিচয়। ফলে আমরা আগে মুসলিম, তারপর বাঙালি। বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি বিধায় আমরা বাঙালি, আরবে জন্মগ্রহণ করলে আরব হতাম। কিন্তু আমরা যেখানেই জন্মগ্রহণ করতাম, আল্লাহর বান্দাই থাকতাম, মুসলিমই হতাম। 

তৃতীয়ত, আমরা মুসলিমরা জাতীয়তাকে একটি জন্মগত বিষয় হিসেবে দেখি, আদর্শগত বিষয় নয়। কারণ আমাদের আদর্শ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত। আমাদের আদর্শের প্রধান পুরুষ হলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমাদের এই আদর্শ অন্য কোনো ব্যক্তি কিংবা কোনো ভূখণ্ডের ভিত্তিতে পরিবর্তিত হওয়ার নয়। ইসলামই আমাদের প্রধান আদর্শ। আমাদের অন্য সকল পরিচয় এই আদর্শের অধীন বিষয়, ঊর্ধ্বের বিষয় নয়। 

আমাদের মুসলিম পরিচয় কখনোই বাঙালি পরিচয়ের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু ছিল না। এই ভূমিতে মুসলিমদের ইতিহাস প্রায় ১৩শ বছরের। এই অঞ্চলে মুসলিমদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি সুদীর্ঘকাল থেকেই চলমান ছিল। কিন্তু বিগত একশ বছরের ইতিহাসে হিন্দুত্ববাদী চক্র মুসলিমদের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে বাঙালি পরিচয় থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পায়তারা করেছে। বাঙালি ও মুসলিম পরিচয়কে মুখোমুখি দাঁড় করাবার চেষ্টা তারা এখনো করছে। ইতিহাসে এই জঘন্য পরিক্রমা ও কালো অধ্যায় নিয়ে আমরা অন্য কোথায় আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

সবশেষে বলব, বর্তমান মুসলিমদের আত্মপরিচয়ের যে সংকট ও রোগ, এর থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো সঠিক উৎস থেকে নিজের আত্মপরিচয় জেনে নেওয়া। যাতে করে আত্মোপলদ্ধি শুদ্ধ হয়। মানবরহস্য ও সৃষ্টির পরিচয় জানার সঠিক মাধ্যম কোনটি—এই ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা আমাদের তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,

اَلَا یَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ ؕ وَ هُوَ اللَّطِیْفُ الْخَبِیْرُ

‘যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই কি জানবেন না? অথচ তিনি সূক্ষ্মদর্শী ও সব বিষয়ে ভালোভাবে অবগত।’ [সুরা মুলক, আয়াত ১৪] 

এই আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে, আমাদের স্রষ্টাই তার সৃষ্টি সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানেন। ফলে আমাদের আত্মপরিচয়ের একমাত্র সঠিক ও শুদ্ধ উৎস হলো আল্লাহর ওহি বা প্রত্যাদেশ। তিনি ওহির মাধ্যমে আমাদের যে আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেটাই আমাদের আসল পরিচয়। এখানে কোনো মানুষে কথা, দর্শন ও তথ্যে আমাদের প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ নেই। আর পূর্বের আলোচনায় আমরা স্পষ্ট করেছি যে, আল্লাহর ওহির সূত্রে আমাদের আত্মপরিচয় কী, কী এর দাবি ও বৈশিষ্ট্যসমূহ। *

*বই: আত্মপরিচয়ের সংকট ১

Read Also :

Getting Info...

Post a Comment

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.