বাংলাদেশের সংবিধান কি যুক্তিযুক্ত?

বাংলাদেশের সংবিধান কি যুক্তিযুক্ত?

বাংলাদেশের সংবিধান কি যুক্তিযুক্ত?

বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে লিখিত আছে দেশের জাতীয় সংসদ অর্থাৎ আইনসভার সম্মতি না লইয়া এই দেশ কোন যুদ্ধ ঘােষণা করিতে পারিবে না, কিংবা পারিবে না কোন যুদ্ধে শরিক হইতেও। 

সংবিধানের ৬৩ নম্বর অনুচ্ছেদের এই বিধান যদি অক্ষরে অক্ষরে পালন করিতে হয় তবে প্রশ্ন করা চলে: যখন একটি জাতীয় সংসদ লােপ পাইয়াছে অথচ আরেকটি সংসদ গঠন করা হয় নাই তখন কী কৰ্তব্য? ইহার উত্তর দেওয়া হইয়াছে ৭২ নম্বর অনুচ্ছেদে। ৭২(৪) অনুচ্ছেদে বলা হইয়াছে সেই জাতীয় অবস্থায় (অর্থাৎ এক জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হইয়াছে বলিয়া কিংবা অন্য কোন কারণে লােপ পাইয়াছে অথচ পরের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নাই তখন) রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন দেশে যুদ্ধাবস্থা দেখা দিয়াছে তখন তিনি লােপ পাওয়া পুরাতন সংসদ ডাকিয়া অধিবেশনে বসাইবেন, আর বসাইয়া যুদ্ধ ঘােষণা কিংবা যুদ্ধে যােগদানের সিদ্ধান্ত অনুমােদনের জন্য পেশ করিবেন। খুবই উত্তম কথা। ইহার নামই সংসদীয় গণতন্ত্র। এই বিধান আদিকাল অর্থাৎ বাংলাদেশের সংবিধান গ্রহণ করিবার সময় হইতেই জারি রহিয়াছে। 

এদিকে ১৯৭৩ সনে গৃহীত সংবিধানের দ্বিতীয় সংশােধনীযােগে জরুরি অবস্থা ঘােষণার বিধান জারি হইয়াছিল। সেই বিধান অনুসারে তিন যুক্তিতে দেশে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করা চলে। প্রথম যুক্তি যুদ্ধ, দ্বিতীয় যুক্তি বৈদেশিক আগ্রাসন আর তৃতীয় যুক্তি আভ্যন্তরীণ গােলযােগ। ইহাতে বােঝা যায় আভ্যন্তরীণ গােলযােগ যুদ্ধ কিংবা বৈদেশিক আগ্রাসনের সহিত সমতুল্য যুক্তি। 

সংবিধানের ১৪১(ক) অনুচ্ছেদের তৃতীয় উপানুচ্ছেদে বলা আছে যুদ্ধ প্রভৃতি অবস্থা সত্য সত্য দেখা দিবার দরকার নাই, দেখা দিবার সম্ভাবনা দেখা দিলেও জরুরি অবস্থা ঘােষণা করা যাইবে। এই রকম বিধান ভারতের সংবিধানেও একদা সংযুক্ত ছিল। 

১৯৭৭ সনে ক্ষমতায় বসার পর জনতা দলের কোয়ালিশন সরকার আভ্যন্তরীণ গােলযােগের কারণে জরুরি অবস্থা ঘােষণার বিধান রদ করিয়াছেন। শুদ্ধ সশস্ত্র বিদ্রোহ দেখা দিলে তাহা করা যাইবে বলিয়া বিধান হইয়াছে। মজার বিষয়, কি বাংলাদেশ কি ভারত কোথাও জরুরি অবস্থা ঘােষণা করিতে হইলে সংসদের অনুমতি লওয়া আবশ্যক মনে করা হয় নাই। 

বাংলাদেশের সংবিধানে ১৪১(ক)(২) উপানুচ্ছেদ বলিয়াছে জরুরি অবস্থার ঘােষণা জাতীয় সংসদে পেশ করা হইবে। আর জাতীয় সংসদের সম্মতি না পাইলে ১২০ দিন পর জরুরি অবস্থা অকার্যকর হইয়া যাইবে। যখন পুরানা সংসদ লােপ পাইয়াছে অথচ নতুন সংসদ গঠিত হয় নাই তখন কী হইবে? 

এই প্রশ্নে বলা হইয়াছে পুনর্গঠিত জাতীয় সংসদ অধিবেশনে বসিবার ৩০ দিনের মধ্যে অনুমতি না মিলিলে জরুরি অবস্থা রদ বলিয়া গণ্য হইবে। যুদ্ধ ঘােষণার বিধানের সহিত জরুরি অবস্থা ঘােষণার বিধানে হেরফের রহিয়াছে। ইহার মানে কী? 

মানে আর কিছুই নহে—আভ্যন্তরীণ গােলযােগের যুক্তিতে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করিতে জাতীয় সংসদের সম্মতি লাগে । লাগিলে যুদ্ধ ঘােষণা পরিস্থিতির মত জাতীয় সংসদ লােপ পাইলেও পুরানা অবলুপ্ত জাতীয় সংসদ ডাকিয়া তাহার সম্মতি লওয়ার বিধান থাকিত।

প্রশ্ন এইখানেই। জরুরি অবস্থা ঘােষণার একটাই পূর্বশর্ত —তাহা হইতেছে রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টি। ১৯৯১ সনে পাশ করা এক সংশােধনী মােতাবেক এই জাতীয় ঘােষণার আগে প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরও সংযুক্ত থাকিতে হইবে। ইহাতেও পরিষ্কার জাতীয় সংসদকে সরাসরি কিছুই জিজ্ঞাসা করিতে হইবে না। আর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর স্থলে কার্যরত যে প্রধান উপদেষ্টা কাজ করিবেন তাঁহার সংযুক্ত স্বাক্ষর দেওয়ার দরকার কিন্তু হইবে না।

২০০৭ সনের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে যে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করা হইয়াছিল তাহার কারণ ও প্রক্রিয়া লইয়া ভবিষ্যতে অনেক লেখা হইবে বলিয়া আশা করা যায়। আমরা তাহা লইয়া কোন অনুমানের মধ্যে যাইতে চাহি না। রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টিই একমাত্র যুক্তি। তিনি সন্তুষ্ট হইয়াছেন । জরুরি অবস্থা জারি হইয়াছে। এই পর্যন্তই।

 তাহাকে কেহ বাধ্য করিয়াছেন কিনা তাহা ভবিষ্যতের স্মৃতিচারণ কবিরা লিখিবেন। আমরা দেখিলাম, রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টিই হইতেছে—বলিতেই হয়—আইনের উৎস ও শেষ অবলম্বন, দুইটাই। 

দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বিপন্ন হইয়াছে কিনা তাহা রাষ্ট্রপতিই বলিবেন। হইতে পারে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সত্য সত্যই বিপন্ন। কিন্তু এমনও তাে হইতে পারে ইহা সত্য নহে—নিছক একটা ব্যাখ্যামাত্র। 

ইহা ভাওতাবাজিও হইতে পারে। আইনের উৎস ও যুক্তি যখন একটা ব্যাখ্যামাত্রের উপর দাঁড়ায় তখন কী হইবে? তখন আইনের জোরটাও কমিয়া যায়। যাহাকে বলে নৈতিক জোর তাহা দুর্বল হইয়া যায়। সেই অবস্থায় আইনের শাসনও রহিত হইয়া যায়। যাইবেই। যাহাকে গণতন্ত্র বলিয়া চালান দেওয়া হয় তাহার ভিতরের এই ভাওতাই জরুরি অবস্থা। 

শুদ্ধ বাংলাদেশে কিংবা ভারতে নহে, সারা দুনিয়ায় এক জাতীয় বিশেষজ্ঞ আইনজ্ঞ আছেন যাঁহারা দাবি করেন—'প্রয়োজনই আইনের জননী।' কথাটা একটু পুরাতন ভাষায় বলিলে দাঁড়ায় প্রয়ােজন কোন আইন মানে না। প্রয়োজন মানে যদি ধরিয়া লই রাষ্ট্রের প্রয়ােজন তাহা হইলে স্বীকার করিতে হয় রাষ্ট্র কোন আইন মানিতে বাধ্য নহে, তাহাকে শুদ্ধ মানিতে হইবে প্রয়ােজন। প্রয়ােজনই কেবল। কেবল পরম । যে আইন কেবল প্রয়ােজনেরই সেবধি তাহা আইন কিনা সেই প্রশ্ন এখানে। তুলিতেছি না। 

শুদ্ধ প্রশ্ন করিতেছি ‘প্রয়ােজন’ জিনিসটা কী? 

তাহার সংজ্ঞা কে নির্ধারণ করিবে? 

যদি তাহা শুদ্ধ রাষ্ট্রপতির উপরই ন্যস্ত থাকে তবে কী বলিব? 

যদি জাতীয় সংসদের হাতে ইহার ভার ন্যস্ত থাকিত তবে না হয় বলিতাম আইন যাহারা বানাইতেছেন তাহারাই সংজ্ঞা দিতেছেন ‘প্রয়ােজন' কী বা কী নয়। এই ভার কেবল রাষ্ট্রপতির মাথায় চাপাইয়া আমরা জিনিসটা হালকা করিবার চেষ্টা করিলাম বটে, কিন্তু তাহা হালকা হইয়াছে কি? 

কোন দেশে কোন এক সময় জরুরি অবস্থা ঘােষণা করিবার মতন অবস্থা দেখা দিয়াছে কি দেখা দেয় নাই তাহা ঘটনা বা সত্য নহে—এক প্রকার মতামত মাত্র। মতামতমুক্ত বিশুদ্ধ সত্য বলিয়া কিছু নাই। থাকিলেও তাহা আন্ধার ঘরে কালাে বিড়ালের মত মিশিয়া থাকে, খুঁজিয়া পাওয়া যায়। । তাহার পরও লােকে বলে আইন পবিত্র, পবিত্র সংবিধান। ভারতে কেহ কেহ সংবিধানকে নবযুগের ধর্মশাস্ত্র বলিয়া সম্মান দেখাইয়া থাকেন। এই কথা আমি এক বিদেশি বিশেষজ্ঞের বইতেও দেখিলাম । (অস্টিন ২০০৪) জরুরি অবস্থার বিধান খােদ সংবিধানেই আছে। তবে থাকিলেও তাহা ধর্মসম্মত (legitimate) কিনা তাহা পরীক্ষা করা দরকার।

চলবে.....

Read Also :

Getting Info...

Post a Comment

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.