অভিধান কী ও কেন?
শিক্ষিত সমাজে যে-ঐহিক (temporal) গ্রন্থটি প্রত্যেক পারিবারিক পাঠাগারে স্থান পায়-বিস্তৃত জায়গা জুড়ে থাকে পুস্তকাসনের – সেটি অভিধান। অভিধান এর শাব্দিক অর্থ শব্দকোষ। ইংরেজি Dictionary শব্দের পরিভাষা হিসেবে বাঙলায় ‘অভিধান’ শব্দটি প্রচলিত।
ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে Dictionary শব্দের অর্থ ‘শব্দভাণ্ডার’, আর ‘অভিধান’ শব্দের অর্থ শব্দার্থ। কিন্তু Dictionary বা অভিধান বর্তমানে ব্যাপক অর্থ বহন করে; পাঠক নানা প্রয়োজনে এ জাতীয় গ্রন্থের দ্বারস্থ হয়। অভিধানে শব্দের বানান, অর্থ, উচ্চারণ, প্রতিশব্দ, পরিভাষা, প্রতিবর্ণ ও ব্যাকরণবিষয়ক নির্দেশ থাকে।
একটি শব্দ বাক্যের মধ্যে কত অর্থে প্রযুক্ত হতে পারে, অভিধান থেকে তাও জানা যায়। সেখানে শব্দের উৎস ও ব্যুৎপত্তিনির্দেশও পাওয়া যায়। অনেক সময় অভিধান সংক্ষিপ্ত বিশ্বকোষের দায়িত্ব পালন করে। শব্দ-সংকলন বা সংকলিত শব্দের গ্রন্থকে গ্রিকরা বলতো লেক্সিকন (lexicon)।
রোমানরা লাতিন ভাষায় একে বলতো ডিকশনারি (Dictionary)। সংস্কৃত পণ্ডিতরা যখন কোনো গ্রন্থের টীকা-ভাষ্য লিখতেন, তখন শব্দের উৎপত্তি-ব্যুৎপত্তি অভিধাব্যঞ্জনা ও বিভিন্নার্থে প্রয়োগ প্রভৃতিও প্রয়োজনমতো লিপিবদ্ধ করতেন। সংস্কৃতে কোষগ্রন্থও ছিল, যা আধুনিক অভিধানের মতোই প্রয়োজন পূরণ করতো।
আমাদের মধ্যযুগীয় বাঙলার লেখকরাও ‘আভিধানিক পর্যায়’ নামে শব্দের প্রতিশব্দ, বিভিন্ন বিপরীতার্থক শব্দ প্রয়োজনে কাব্যে প্রয়োগের জন্যে তৈরি করে রাখতেন হাতের কাছে। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রয়োজনে জেনে নিতেন উপস্থিত পণ্ডিত থেকেই। এক অর্থে বাক্যবিচ্ছিন্ন শব্দমাত্রই বোবা। বাক্যে ব্যবহৃত শব্দই প্রয়োগভেদে বিভিন্ন বাচ্যার্থ ও ব্যঙ্গার্থ লাভ করে।
কাজেই অভিধানে বিধৃত শব্দমাত্রেরই প্রতিশব্দ বা বাচ্যার্থ কিংবা ব্যাঙ্গার্থ প্রয়োগসম্ভব অভিধা নির্দেশ করে মাত্র। শব্দের আপাতমুখ্য অর্থই হচ্ছে 'অভিধা'। তাই শব্দার্থ-গ্রন্থের নাম অভিধান। এই অভিধানের অপর নাম শব্দার্থকোষ।
চোম্কির মতে ‘অভিধান (বা শব্দকোষ) হচ্ছে একরাশ শব্দভুক্তি, যাতে প্রতিটি শব্দ-ভুক্তি হচ্ছে (ধ্ব, ব)-র যুগল, যেখানে ‘ধ্ব’ হচ্ছে শব্দটির ধ্বনিরূপ নির্দেশক স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের ম্যাট্রিক্স, আর ‘ব’ হচ্ছে একগুচ্ছ বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের সমষ্টি (অর্থাৎ একটি মিশ্রপ্রতীক)। এখন অভিধান শব্দের অর্থ ব্যাপক ও গভীর হয়ে গেছে। এখন অভিধান নিতান্ত শব্দকোষ নয়, এনসাইক্লোপিডিয়ার কাছাকাছি জ্ঞানকোষও।
এখন শব্দের মূল, গঠনপ্রকৃতি, প্রত্যয়রূপ, উচ্চারণ, বিভিন্ন অর্থে সপ্রমাণ প্রয়োগবৈচিত্র্য, শব্দটির আদি প্রয়োগ, অর্থের প্রসার কিংবা অর্থান্তর কাল, অপ্রচলিত হলে প্রয়োগ-বর্জনকাল, কোনো সামাজিক-ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পৃক্ত থাকলে তারও উল্লেখ, শব্দের পদান্তর রূপ ও প্রয়োগ প্রভৃতিও একালের একটা ভাষা-প্রতীক, -প্রতিম ও -প্রতিভূ অভিধানে প্রত্যাশিত। একালের অভিধানে নানা বিষয় বিন্যস্ত থাকে পরিশিষ্টে।
যেমন বিদেশি শব্দের তালিকা ও অর্থ, প্রসিদ্ধ স্থানের ও রাষ্ট্রের নাম, বিখ্যাত কৃতী ও কীর্তিমান ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, বিশ্বে বিখ্যাত সাহিত্যগ্রন্থের পরিচিতি, পৌরাণিক কাল্পনিক দেবতা, অপদেবতা, দৈত্য, দানব, রাক্ষস, জীন, পরী প্রভৃতির পরিচিতি, বিভিন্ন দেশের পতাকার, মুদ্রার, ভূমি, দ্রব্য ও তরল পদার্থের পরিমাপ ও পরিমাণ নিরূপণ পদ্ধতি প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানদানের ব্যবস্থা থাকে।
যদিও অভিধানের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে এক বা একাধিক শব্দের অর্থ নির্দেশ করা; কিন্তু অভিধান ব্যবহারকারীরা শব্দের নির্ভুল বানান, উচ্চারণ, এবং অনেক সময় ব্যুৎপত্তি জানার জন্যেও অভিধান ব্যবহার করে। অনেকের কাছে অভিধান একটি অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় গ্রন্থ— ভাষিক বা শাব্দিক শুদ্ধতার শেষ কথা যেন লিখিত হয়ে আছে অভিধানে, কোনো সন্দেহ বা অশুদ্ধি নিরসনের জন্যে ওই গ্রন্থটির ঠিক পৃষ্ঠাটি খুললেই যেন মিলবে শুদ্ধতার পরম রূপের পরিচয়।