ইসলামী পরিভাষায় যাকাতের দু'টি অর্থ দাঁড়ায়।
এক. এমন ধন-সম্পদ যা পরিশুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে বের করা হয়। দুই. পরিশুদ্ধ করার মূল কাজটি যদি ও বলা হয় তাহলে এর অর্থ হবে তারা পরিশুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে নিজেদের সম্পদের একটি অংশ দেয়। এভাবে শুধু সম্পদ দেয়ার মধ্যেই ব্যাপারটি সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু যদি বলা হয় - যা বলা হয়েছে সূরা মুমিনূন-এর ৪ নং আয়াতে, তাহলে এর অর্থ হবে তারা পরিশুদ্ধ করার কাজ করে এবং এ অবস্থায় ব্যাপারটি শুধুমাত্র আর্থিক যাকাত আদায় করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং আত্মার পরিশুদ্ধি, চরিত্রের পরিশুদ্ধি, জীবনের পরিশুদ্ধি, অর্থের পরিশুদ্ধি ইত্যাদি প্রত্যেকটি দিকের পরিশুদ্ধ পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়। নিজের জীবনের পরিশুদ্ধি ছাড়াও চারপাশের জীবনের পরিশুদ্ধি পর্যন্ত বিস্তৃত হয় অর্থাৎ মুমিনরা নিজেদেরকে যেমন পরিশুদ্ধ করে, তেমন অন্যদেরকেও পরিশুদ্ধ করার দায়িত্ব পালন করে। তারা নিজেদের মধ্যে যেমন মৌল মানবিক উপাদানের বিকাশ সাধন করে তেমনি বাইরের জীবনেও তার উন্নতির প্রচেষ্টা চালাতে থাকে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন-
قد أفلح من تزكى ـ وذكر اسم ربه فصلی -
Truly he succeeds that purifies it. And he fails that corrupts it.
“সফলকাম হয়েছে সে ব্যক্তি যে পবিত্রতা অর্জন করেছে এবং নিজের রবের নাম স্মরণ করে নামায পড়েছে।” (সূরা আল আ'লা : ৯-১০)
যাকাত সকল নবীদের দ্বীনে বা জীবন ব্যবস্থায় ফরয ছিল এবং সকল নবীই এর প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছেন। অন্যান্য সব নবীদের মতো বনী ইসরাঈলদের নবীগণও এর প্রতি কঠোর তাগিদ দিয়েছিলেন। কিন্তু ইহুদীরা এ ব্যাপারে গাফেল হয়ে পড়েছিল। তাদের সমাজে যাকাত ব্যবস্থা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং যাকাতের পরিবর্তে তারা সুদ খেতো।
হযরত মূসা (আ.) এর জাতির লোকদের হৃদয় ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ। ধন-সম্পদের জন্য জীবন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করত না। এজন্য আল্লাহ তায়ালা এ মহান সম্মানিত পয়গাম্বরের প্রার্থনার জবাবে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন যে, তোমার উম্মত যথারীতি যাকাত আদায় করলে আমার রহমত পেতে পারবে।
অন্যথায় জেনে রেখ তারা আমার রহমত হতে বঞ্চিত হবে এবং আমার আযাব তাদেরকে বেষ্টন করবে। হযরত মূসা (আ.) এরপরেও বনী ইসরাঈলদেরকে বার বার এ সতর্ক করা হয়েছে। সর্বশেষ তাদেরকে সুস্পষ্ট নোটিশ জারি করে দেয়া হলো-
وقال الله إني معكملين أقمتم الصلاة وآتيتم الزكـاة وآمنــم برشـلي وعزرتموهم وأقرضتم الله قرضا حسنا لأكفرن عنكم سيئاتكم.
And Allah said: I am with you if ye (but) establish regular prayers, pay Zakat believe in my Messengers, honor and assist them, and loan to Allah a beautiful loan, verily I will wipe out from you your evils.
আল্লাহ বললেন, হে বনী ইসরাঈল: তোমরা যদি নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় করতে থাক, আমার রাসূলদের প্রতি ঈমান আন, তাদের সাহায্য কর এবং আল্লাহকে করযে হাসানা দাও। তাহলে আমি তোমাদের সাথী এবং তোমাদের দোষ ত্রুটিগুলো দূর করে দেব অন্যথায় রহমত লাভের কোন আশাই তোমরা করতে পার না।” (সূরা আল মায়েদা : ১২)
একমাত্র দয়াময়, রাজাধিরাজ আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহের যথার্থতা এখানেই। আমাদের কাছে যা কিছু আছে, তা সবই তাঁরই দান-অন্য কোথাও থেকে বা অন্য কারো কাছ থেকে আমরা তা পাই না। তাঁরই ভাণ্ডার থেকে আমরা পেয়ে থাকি, কিন্তু যা কিছু আমরা দেই, তাঁকে নয় বরং আমাদেরই আত্মীয়, ভাই, বন্ধু ও নিজ জাতির লোকদেরকেই দিয়ে থাকি কিংবা নিজেদের সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করি, যার ফল শেষ পর্যন্ত আমরাই পেয়ে থাকি। কিন্তু সেই মহান দাতার বদান্যতার প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় তিনি এসকল দান সম্পর্কে বলেন যে, এটা তাঁকে ঋণ দেয়া হয়েছে, এর ফল আমিই তোমাদের দেব, বস্তুত বদান্যতার এ অতুলনীয় পরাকাষ্ঠা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার পক্ষেই শোভা পায়, কোন মানুষ এর ধারণাও করতে পারে না।
একজন মুমিন কখনো এ সুযোগ হাত ছাড়া করতে পারে না। সে আল্লাহর সাথে এ ব্যবসায় লিপ্ত হয়ে নিজ সম্পদকে যেমন পবিত্র রাখবে তেমনি আবার নিজেকেও পবিত্র করবে এবং সে নিজেকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وأنفقوا في سبيل الله ولا تلقوا بأيديكم إلى التهلكة.
And spend of your substance in the cause of Allah, and make not your own hands contribute to (your) destruction.
“আল্লাহর রাস্তায় খরচ কর এবং নিজের হাতেই নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করো না (আল্লাহর রাস্তায় খরচ না করলেই নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করা হয়)।" (সূরা আল বাকারা : ১৯৫)